ঢাকা, ০৯ মে, ২০২৪
সর্বশেষ:

শহীদ পরিবারে ক্ষোভ: রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৫০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের প্রথম তালিকায় নানা অসঙ্গতির অভিযোগ উঠেছে। এতে এমন সব ব্যক্তির নাম এসেছে, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, লড়াই করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। 

কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকী শহীদ পরিবারের সদস্যদের নামও রয়েছে তালিকায়। অথচ এতে নেই চিহ্নিত অনেক রাজাকারের নাম। এসব কারণে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত রাজাকারদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে কোনো ভুলত্রুটি আছে কি না, সেটা আমরা জানি না। তালিকা প্রকাশের পর অনেকে ফোন করে বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামও তালিকায় রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির নামের সঙ্গে অন্য কারোর নামের মিলের কারণে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকতে পারে। তারপরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে, সেগুলো বিবেচনা করা হবে।’

রাজাকারের তালিকার অসঙ্গতি নিয়ে অভিযোগ ওঠার আগে থেকেই সবাইকে সাবধান করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তারা বলেন, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের তালিকা প্রকাশের মতো কাজ একটি ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ। এটা শুধু মন্ত্রণালয়, প্রশাসন বা জেলা প্রশাসক-উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে সম্পন্ন করা যাবে না। এই কাজে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারা বলেন, তালিকাটি প্রকাশের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হলে অসঙ্গতিগুলো ধরা পড়ত। সেক্ষেত্রে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকত না।

মুক্তিযোদ্ধা মিহির লাল দত্ত ও তপন চক্রবর্তীর নাম তালিকায় : বরিশাল ব্যুরো জানায়, রাজাকারের তালিকায় ভাষাসৈনিক ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মিহির লাল দত্তের নাম এসেছে। বরিশাল বিভাগের তালিকায় ২২নং পাতায় ৯৪নংয়ে তার নাম আছে। সেখানে তার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে জীতেন্দ্র দত্ত। রাজাকারের তালিকায় পিতার নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত। তিনি জানান, ‘আমার বাবা একজন ভাষাসৈনিক এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তার মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নং ২৮৯ ২১/০৫/২০০৫ এবং মুক্তিবার্তা নং ০৬০১০১১০৬০। এছাড়া মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত সাময়িক সনদ নং ম২৮৬১৬। তার নাম কীভাবে রাজাকারের তালিকায় এসেছে, সেটা আমার বোধগম্য নয়। যারা এই তালিকার সঙ্গে জড়িত, তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।

জানা যায়, ২০০৭ সালের ২০ জানুয়ারি মিহির লাল দত্ত মারা যান। তিনি কবি, নাট্যকার, গীতিকার, ছোটগল্পকার ও ভাষাবিদ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন । তার বাবা জীতেন্দ্র লাল দত্ত এবং মেজো ভাই সুবীর দত্ত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।

এদিকে রাজাকারের তালিকায় বরিশালের আরেক গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তীর নাম এসেছে। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়ে থাকেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার মেয়ে ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী বাসদ নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তী। এ ঘটনাকে নিজের ‘রাজনীতির খেসারত’ আখ্যা দিয়েছেন বাসদ বরিশালের সদস্য সচিব এই মুক্তিযোদ্ধাকন্যা। তিনি লিখেছেন, সদ্য প্রকাশিত রাজাকারদের গেজেটে আমার বাবা এবং ঠাকুরমার নাম প্রকাশিত হয়েছে। আমার বাবা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা, ক্রমিক নং ১১২, পৃষ্ঠা ৪১১৩। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়ে থাকেন। আজ রাজাকারের তালিকায় তিনি ৬৩ নম্বর রাজাকার!’ ডা. মনীষা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ঠাকুরদা অ্যাডভোকেট সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে পাকিস্তানি মিলিটারি বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তিনিও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। তার সহধর্মিণী আমার ঠাকুরমা ঊষা রানী চক্রবর্তীকে রাজাকারের তালিকায় ৪৫ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

তালিকায় নাম আসায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর বিস্ময় : রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহী বিভাগের ৮৯ নম্বর তালিকায় (ক্রমিক নম্বর ৬০৬) নাম রয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুসহ ৫ জনের নাম। তালিকায় নাম আসায় বিস্মিত ও হতবাক গোলাম আরিফ টিপু। তিনি বলেছেন, এ ঘটনায় দেশের নাগরিক হিসেবেও আমি লজ্জিত। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে যার ভূমিকা ছিল তাকে কারা কেন এই তালিকায় এনেছে, এর তদন্ত হওয়া উচিত। এই পাঁচজন এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট মহসিন আলীর নামও রয়েছে তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের পরিবারের ৫ সদস্য নিহত হন। ওই সময় আবদুস সালাম ভারতে অবস্থান করছিলেন। অথচ তার নামটিও রয়েছে রাজাকারের তালিকায়। এছাড়া তালিকায় আছে রাজশাহীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ ও পুলিশ কর্মকর্তা এসএস আবু তালেব।

রাজাকারের তালিকায় এসব ব্যক্তির নাম দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের পরিবারের সদস্য আরিফুল হক কুমার। তিনি বলেন, এই তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা ছিলেন, তাদের নাম এসেছে। এমনকি যারা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের নামও এসেছে। আবার যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, তাদের নাম রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর, তার নামও আছে এতে। বিষয়টি বড়ই বেদনাদায়ক। আমরা কোনোভাবেই এটি মানতে পারছি না।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, তালিকায় রাজশাহীর অন্যতম রাজাকার তৎকালীন জামায়াতের আমীর অ্যাডভোকেট আফাজ উদ্দিন, শান্তি কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন এবং ওয়াহেদ আলী মোল্লার নাম নেই। অথচ এই তিনজনই রাজশাহীর রাজাকারদের শীর্ষস্থানীয়। তাদের নাম এ তালিকায় না থাকা খুবই দুঃখজনক। অন্যদিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের নাম তালিকায় আসাটা চরম লজ্জার।

তালিকায় যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের নাম : বগুড়া ব্যুরো জানায়, রাজাকারের তালিকায় আদমদীঘি উপজেলার ৩০ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি কছিম উদ্দিন আহম্মেদের নাম। আছে আওয়ামী লীগের সাবেক এমএলএ মজিবর রহমান (আক্কেলপুর), মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মনছুর আলী, আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি তাহের উদ্দিন সরদার, রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযোদ্ধা জাহান আলী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আমিরুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদের নাম। এছাড়া রাজাকার নন এমন আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে। এই তালিকা দেখে হতবাক আদমদীঘিবাসী।

আদমদীঘি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল হামিদ জানান, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজাকারের তালিকা করা হয়েছে। যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের নাম রাজাকারের তালিকায় দেখে হতবাক হয়েছি। আদমদীঘির যুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডার হাফিজার রহমান জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বানানোর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। উল্লেখ্য, রোববার প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যাচাই-বাছাই করে ধাপে ধাপে আরও তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

সূত্র: যুগান্তর

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত