ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

বাংলার বব ডিলান সঞ্জীব চৌধুরী

নিউজওয়ান২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০২২  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো


মানুষ জন্মগ্রহণ করে,পৃথিবীতে জীবনযাপন করে কিছুদিন, তারপর মৃত্যুতে ঘটে তার পরিসমাপ্তি। এভাবে যতো মানুষ আসে,সবাই চলে যায়। দু’চারদিন পর তাকে ভুলে যায় সবাই। এটাই সাধারণের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। কিন্তু যিনি কীর্তিমান, মানুষের মনে অপার ভালোবাসা যিনি রেখে যান, তাকে কেউ বিস্মৃত হয় না। তিনি থাকেন এবং নানা প্রসঙ্গে ঘুরে-ফিরে আসেন আমাদের মধ্যে। এমনই একজন মানুষ সঞ্জীব চৌধুরী,আমাদের প্রিয় সঞ্জীবদা।

কত কিছুই না সঞ্জীব চৌধুরী হতে পারতেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের এই ছাত্র প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার লোভনীয় চাকরি হাতের মুঠোয় ছিল। আরও কত প্রলোভনের হাতছানি। কিন্তু তিনি জীবন জুড়েই যেন কড়া নাড়লেন ভুল দরজায়.।

বুক জুড়ে এই বেজান শহর/ হা হা শূন্য আকাশ,কাঁপাও/ আকাশ ঘিরে শঙ্খচিলের শরীর চেরা কান্না থামাও/ সমুদ্র কি তোমার ছেলে/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও- এমন অনবদ্য অনেক কথা ও গান রেখে গেছেন ক্ষণজন্মা সাংবাদিক-সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী।

১৯৬৪ সালে ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সঞ্জীব চৌধুরী। তার পিতার নাম গোপাল চৌধুরী, মা প্রভাষিনী চৌধুরী। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সপ্তম ছিলেন তিনি। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর ঢাকার বকশী বাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা শেষ না করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

"""আমি তো তাদেরই জন্য,
সূর্যের দিকে চেয়ে থাকবার অভ্যাসে যারা বন্য!
আমি তো তোমারই জন্য,
কপাল রাঙানো যে মেয়ের টিপ রক্তের ছোপে ধন্য!"""

এই রঞ্জিত উজ্জ্বল পথ ধরেই ১৯৭৮ সালে মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তার আদি নিবাস ছিল সিলেটের হবিগঞ্জে। অত্যন্ত মেধাবী, সংস্কৃতিমনা ও প্রগতিশীল পরিবেশে তার জন্ম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যান্টিনে তার কাছে দেখা যেত কবিতার বই। প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের না প্রেমিক না বিপ্লবী, প্রেমাংশুর রক্ত চাই; আরও থাকত আবুল হাসান (অকালপ্রয়াত) রচিত যে তুমি হরণ করো, পৃথক পালঙ্ক ও রাজা যায় রাজা আসে। এ ছাড়া দেখা যেত মহাদেব সাহার চাই বিষ অমরতা আর শামসুর রাহমান, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা।

গণিতে ভালো দখল ছিল বলে তার পরিবার স্বপ্ন দেখত, তিনি হয়তো একজন প্রকৌশলী হবেন। আর ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া খুব কম ছাত্রই পরে ব্যান্ড গিটারিস্ট, সাংবাদিক বা কবি-গীতিকবি হয়েছেন।

কামিয়াব সঞ্জীব তাই সফল অর্থেই ‘দলছুট’। ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ই তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ছিল, স্বপ্ন ছিল, একটি বৈষম্যহীন অসাম্প্র্রদায়িক সমাজের জন্য সমাজবদলের লড়াইয়ে সময়, মেধা ও জীবন উত্সর্গ করবেন। ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সময়ে লেখাপড়া, ছাত্র পড়ানো আর দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে সঞ্জীব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তার গান, কবিতা আর ছড়ায় ছিল নতুন দিনের হাতছানি। আশির দশকের অস্থির সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত হয় সঞ্জীবের রাশপ্রিন্ট গ্রন্থটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা সঞ্জীব চৌধুরী আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি শুরুর দিকে ‘শঙ্খচিল’ নামের একটি দলে সংগীতচর্চাও করতেন।

এরপর ১৯৯৬ সালে সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে গড়ে তোলেন ব্যান্ড ‘দলছুট’। সঞ্জীব চৌধুরী ও বাপ্পার যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই ব্যান্ডের অ্যালবামগুলো হলো- আহ্ (১৯৯৭), হৃদয়পুর (২০০০), আকাশচুরি (২০০২) ও জোছনা বিহার (২০০৭)।

সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে- ‘বায়স্কোপ’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘আমি তোমাকে বলে দিব’, ‘রিকশা’, ‘কথা বলবো না’, ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে আউলা বাতাস খেলে’, ‘চোখ’, ‘তখন ছিল ভীষণ অন্ধকার’, ‘আহ ইয়াসমিন’ প্রভৃতি।

শিল্পী হিসেবে যতোটা জনপ্রিয় ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক গীতিকারই তার দ্বারা প্রভাবিত। গানের পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন সঞ্জীব চৌধুরী। দেশের প্রায় সব পত্রিকায়ই তার কবিতা ছাপা হয়েছে। তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম রাশপ্রিন্ট। শুধু কবিতা নয়,সঞ্জীব চৌধুরী বেশ কিছু ছোট গল্প ও নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সঞ্জীব চৌধুরী অভিনীত একমাত্র নাটক সুখের লাগিয়া।

সঞ্জীব চৌধুরী বাইল্যাটারাল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নভেম্বর ১৫, ২০০৭ সালে আকস্মিকভাবে অসুস্থ বোধ করার কারণে তাকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। তিন দিন পর নভেম্বর ১৯ তারিখে আইসিইউ শাখায় সঞ্জীব চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেকে দান করে গেছেন।

সৃজনশীল ও মেধাবী এ মানুষটির মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৃজনশীলতার অনেক শাখা। তবু আমাদের বলতে হয়,সঞ্জীব চৌধুরীদের মৃত্যু নেই,তারা চিরকালই মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর!

১৫ বছর পার হয়ে গেছে সঞ্জীব চৌধুরী  বিহীন, তবু মনে হয়, আমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। তিনি তার ভক্তদের কাছে বাংলার বব ডিলান কিংবা প্রিয় সঞ্জীবদা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

সূত্র: ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত

নিউজওয়ান২৪.কম/আরএডব্লিউ

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত