ঢাকা, ০৭ মে, ২০২৪
সর্বশেষ:

যে কারণে তৈমুরকে রাজি করাতে পারেননি খালেদা!

ফিদানূর সুদর্শন

প্রকাশিত: ১৪:৩১, ২২ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ১৩:১৫, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

নারায়ণগঞ্জ ঘূরে এসে: বহুল আলোচিত সাত খুন মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তিনি নারায়ণগঞ্জ নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।

আর তাই সাখাওয়াতই এবারের মেয়র নির্বাচনে লড়বেন বর্তমান মেয়র ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে।

অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জে বিএনপির বহুল প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম এবার প্রার্থী হলেন না। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুরোধেও তিনি রাজি হননি মেয়র হিসেবে লড়তে।

তার এই রাজি না হওয়ার ‘কারণ’টাও গোপন নেই- ক্ষমতাসীন সরকারের তাবেদার নির্বাচন কমিশনের প্রতি তার আস্থা নেই বলেই তিনি নির্বাচন করছেন না বলে জানা গেছে।

তবে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে ‘অন্য ঘটনার’ কথা। এই অন্য ঘটনা জানতে হলে একটু ভেতরে যেতে হবে।

সূত্র মতে, গতবার নির্বাচনের একেবারে আগের রাতে খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান তৈমুর। তখন রাজনৈতিক দাবার চালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমানকে ঠেকাতে নিজের প্রার্থীকে হটিয়ে নেওয়ার সেই চরম সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর ফলে দলীয় সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো সাবেক পৌর মেয়র আইভী এক লাখ দুই হাজার ভোটেরও বেশি ব্যবধানে হারান দোর্দণ্ড প্রতাম শামীম ওসমানকে।

এখানে একটি কথা বলতে হয়। নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মহলেও বিষয়টি সবাই জানেন। তা হলো, শামীম ওসমানের বিষয়ে বিএনপি তথা দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘অসোয়াস্তি’। বিষয়টি অনেকটাই ব্যক্তিগত ইস্যুর পর্যায়ের। কারণ, শামীম ওসমান বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একেবারে ‘অকৃত্রিম অশ্রদ্ধা’ প্রকাশ করেছিলেন- তাও সাইনবোর্ড আকারে।

ঘটনাটা ছিল- একটা সময়ে নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের প্রবেশমুখে (সাইনবোর্ড এলাকা) একটি ঘোষণা লেখা বোর্ড দেখা যেত যাতে খালেদা বিরোধী অবমননাকর বক্তব্য ছিল। ওই ঘোষণাটি ছিল এরকম- খালেদা জিয়া ও গোলাম আযমের প্রবেশ নিষেধ! এটা করা হয় শামীম ওসমানের নির্দেশে। আর শামীম ওসমান পক্ষ মনে করে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতোই নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা চালিয়ে শামীম ওসমানকে হত্যা চেষ্টার পেছনে হাত আছে বিএনপি ঘরানার লোকজনেরই।

অপরদিকে, ক্ষমতাহারা বিএনপির জন্য ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে জয়ী হওয়া খুব প্রয়োজন ছিল। আওয়ামী লীগ শামীমকে প্রার্থী করবে- বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তারা শক্তিশালী এবং যোগ্য প্রার্থী তৈমুরকে দাঁড় করায়। কিন্তু ওদিকে জনপ্রিয় পৌর মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী হতোদ্যম না হয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ধেতে যান। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পৌর মেয়র আলী আহমদ চুনকার জনপ্রিয়তা ছিল নারায়ণগঞ্জের ঘরে ঘরে। আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, এমনকি জামায়াতের ভোটারদের মাঝেও তার প্রচুর ভোট রয়েছে।

আরও পড়ুন ৫বছর আগের না পাওয়া মনোনয়ন এবার পেলেন আইভী, সমর্থকদের মাঝে স্বস্তি

এমন অবস্থায় এটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শামীম, তৈমুর আর আইভী- এই তিন হেভিওয়েটের শক্তি প্রদর্শেনে শামীম বাজি মেরে দেবেন। কারণ, শামীম বিরোধী সব ভোট এখন আর তৈমুর পাবেন না, তার বড় অংশটা যাবে আইভীর বাক্সে। আর জামায়াতের হাজার তিরিশেক ভোটেরও কিছু যাবে আইভীর দিকে এবং অতি অবশ্যই বিএনপির কয়েক হাজার ভোটও একই লক্ষ্যে ছুটবে। এর ফল হবে- তৈমুর বা আইভী কেউই জিতবেন না। শেষ হাসি হাসবেন শামীম ওসমান।

তাই বিএনপি পক্ষের চাণক্য নীতি ছিল- তৈমুরকে সরিয়ে নাও, আইভীর পখ পরিষ্কার হয়ে যাবে। এতে অন্তত বিএনপি প্রার্থী না জিতলেও শামীম ওসমানকে ঠেকানো যাবে। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই।

তবে ভোটের আগের সেই রাতে তৈমুর যখন নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন, তখন সেখানে উপস্থিত সবাই তার চোখের পানি দেখেছে। বিএনপির অপরাপর নেতাকর্মীরা এবং তৈমুর আলম খন্দকারও তখন থেকে নিশ্চিত ছিলেন, পরেরবার তিনি আসছেন।

এর মধ্যে শীতলক্ষ্যায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। শামীম ওসমান এমপি হয়েছেন। মেয়র পদে তার দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। এটা তৈমুরের জন্য সুখবর ছিল। আর আগের বারের হিসাব বিবেচনায় আইভীকে তো আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে না- এটাও অনেকে মনে করেছিলেন। তাই তৈমুর দাঁড়ালেই এবার জিতে যাবেন, এমন ভাবনা নারায়ণগঞ্জে অনেকেই ভাবছিলেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ হঠাৎ ওভারট্রাম্প করে বসলো। মেয়র মনোনয়নের জন্য শামীম ওসমানের অনুগত জেলা আওয়ামী লীগের পাঠানো তিন নামকে অগ্রাহ্য করে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা আইভীর পক্ষেই মত দেন।

এই পরিস্থিতি ফের তৈমুরের আশার গুড়ে বালি দিয়ে দেয়। কারণ, এখন দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আইভী আরও শক্তিশালী। আগেরবার দলের বিরাগভাজন হয়েও শামীমকে আছড়ে ফেলেন, আর এবারতো বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের একজন (মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের বিবেচনায় মুসলিম নারী হিসেবে এক নম্বর প্রভাবশালী) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ রয়েছে তার ওপর। আর হাসিনার হুকুম সত্ত্বেও শামীম ওসমান পর্দার আড়ালে যদি কলকাঠি নাড়েনও- তবু আইভীকে ঠেকানো কঠিন কাজই হবে এবারও।

আরও পড়ুন যে ৫ কারণে মুখ থুবড়ে পড়লো আইভী বিরোধী সব কৌশল

কারণ, প্রশাসনের অলিখিত যে সুবিধা গতবার শামীম পেয়েছেন এবার তা পাবেন আইভী। মেয়র হিসেবে গত ৫ বছরে অনেক অনেক কাজ করেছেন আইভী। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের শীতলক্ষ্যার ওপারের অংশ- অবহেলিত বন্দর এলাকায় তার ছিল বিশেষ মনোযোগ। কাজ করেছেন সিদ্দিরগঞ্জ আর মূল নারায়ণগঞ্জ শহরেও। তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিপক্ষের করা মানহানিকর অপপ্রচারগুলোও তার পক্ষেই গেছে। ২২ ডিসেম্বরে ভোটের দিন এই বিষয়টিও তার পক্ষে ব্যালটে সিলমারা বাড়িয়ে দেবে।

এমন অবস্থায়, তৈমুর আবার গাঁটের টাকা খরচ করে মুখ রক্ষার নির্বাচনে অংশ নেবেন? গতবার তো শেষ মুহূর্তেও তিনি জানান দিচ্ছিলেন যে তার ইচ্ছা নেই পিছু হটার কিন্তু চেয়ারপারসনের ইচ্ছায় তিনি তা করছেন। নির্বাচনের পেছনে তার বিশাল অংকের অর্থ নাশের কথাও বলেছিলেন তখন দুঃখ করে।

এই পটভূমিতে তৈমুর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজওয়ান২৪.কমকে জানান, তৈমুর নির্বাচন করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু তার দুটি শর্ত ছিল। এর একটি হলো তিনি নিজে মনোনয়ন চাইবেন না- চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে নিজে আহ্বান করবেন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- নির্বাচন বাবদে তিনি কোনো টাকা খরচ করবেন না এবার। কারণ, গতবারের ‘লসের টাকা’ ফেরত পাননি তিনি। সুতরাং, এবার সবটাই দিতে হবে দল থেকে।

তো গতকাল (সোমবার) গুলশানে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে বিএনপির নাসিক মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন মিটিংয়ে তৈমুরের প্রথম শর্তটি পূরণ হয়। চেয়ারপারসন তাকে প্রার্থী হতে বলেন। কিন্তু দুই নম্বর শর্তের ব্যাপারটা আগেই বাড়েনি। তাই তৈমুর ‘যত দোষ নন্দ ঘোষে’র মতো নির্বাচন কমিশনের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নিতে অনাগ্রহের কথা জানান।

এদিকে, রাজধানী ঢাকার লাগোয়া এই সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে- নারায়ণগঞ্জের বৃহত্তর জনতা মনে করছে, গতবার আইভী আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমানের বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন এক লাখ দুই হাজার ভোটের ব্যবধানে। আর এবার তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত তথা ধানের শীষের বিরুদ্ধে জিতবেন দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে।

জেলার একজন শীর্ষ সাংবাদিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বললেন, ভোট নষ্ট হবে বিবেচনায় এবার জামায়াত ভোটাররা ভোটই দেবে না বলা যায়। আর বিএনপির বেশিরভাগ ভোটও পড়বে নৌকার বাক্সে। কারণ, নারায়ণগঞ্জে শামীমের প্রতিপক্ষ বলতে এখন আইভীকেই বোঝায়। বিএনপির সচেতন মহল বুঝতে পারছে যে আইভী এখন আরও দশগুণ শক্তিশালী। তাকে হারানো অনেকটাই অসম্ভব মনে হচ্ছে তাদের কাছে। তাই, শামীম ওসমানের পক্ষে দাঁড়ানো কেউ জিতলে তা তাকে করে তুলবে নারায়ণগঞ্জের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক। যা খালেদার সঙ্গে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে জড়ানো শামীমকে করে তুলতে পারে আরও বেপরোয়া। সেক্ষেত্রে তিনি হয়ে উঠবেন জামায়াত-বিএনপি সংহারক দানবে। সেই ‘দানবের রোষে’ পড়ে ছারখার হতে চান না নারায়ণগঞ্জ বিএনপির কুশীলবরা। এমনিতে তারা তো খুব একটা খারাপ নেই আইভী-শামীম দ্বৈরথের বাস্তবতায়!

বাস্তবতা তাদের সেই পথে চলতেই নির্দেশ দিচ্ছে। তাই তারাও চাইবেন আইভীকেই জেতাতে। বিএনপির ভোট যাতে বেশিভাগ আইভী তথা নৌকার বক্সে পড়ে, সেই চেষ্টাই তারা করবেন। আর নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দলীয় বক্তব্য তো রেডিই আছে- কারচুপি করে জিতে গেছে নৌকা! কারণ, তৈমুর তো আগেই বলে রেখেছেন- সরকারের তাবেদার নির্বাচন কমিশনে তার আস্থা নেই। সে হিসাবে ২২ ডিসেম্বরের ফলাফল বের হওয়ার পর তার পক্ষ নিয়ে দলের সবাই বলবেন- হ্যাঁ, আমরা তো আগেই বলেছিলাম। আমরা জানতাম ফলাফল এমন হবে- শুধু গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি।

শুধু দেশ-বিদেশের মানুষ জানবে না যে বিএনপির সেই ‘জানাটা’ আসলে ‘কী’ জানা ছিল। কারণ, তারা নিজেরাই ভোট দিয়ে আইভীকে বিপুল ভোটে জেতাতে ভূমিকা রাখবে এবার।

এখানে বাস্তবতা বিবেচনায় রাখতে হবে। নারায়ণগঞ্জ আওয়অমী লীগে শামীম ঘনিষ্ঠ অনেকেই আইভীর কারণেই তার ঘনিষ্ঠ। কারণ, শামীম তাদের দূরে ঠেলে দিলে তারা আইভীর ছাতার তলে ভিড়বে। আর আইভী যদি মেয়র না থাকেন- তখন শামীমের কাছেও তাদের গুরুত্ব কমে যাবে। তাই তারাও চাইবেন, শামীমের ‘লাল কেল্লার’ মুখোমুখি আইভী নামের ‘কুতুব মিনার’ একটা থাকুক নারায়ণগঞ্জে।

সুতরাং যারা মনে করছেন, শামীমের পক্ষ গোপনে আইভী বিরোধী ভূমিকা রাখবে যা তাকে বেকায়দায় ফেলে দেবে- তাদের ধারণা ঠিক নয়। শামীমের শিবিরের অনেকেই নিজেদের ভবিষ্যত নিরাপদ রাখতে আইভীর পক্ষে জানপ্রাণ দিয়ে লড়বে। ফলে আইভী জিতে যাবেন- এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। অন্তত বুদ্ধিমান তৈমুর আলম খন্দকারের সেই সন্দেহ একেবারেই নেই- এটা পরিষ্কার।

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত