ঢাকা, ১৯ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ:

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন ‘জোটবদ্ধ’ নির্বাচন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি


বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৮০ সাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করছে। এখানে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছোট দলগুলোকে শরিক করে মহাজোট ঘোষণা করে। আবার বিরোধী দলগুলোও তাদের নিজেদের সঙ্গে রাজনৈতিক নীতিতে মিল খুঁজে পাওয়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, বড় দলগুলো কেন ছোট দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় যেখানে তাদের প্রভাব খুব কমই থাকে? 

সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন একটি রাজনৈতিক জোটে যুক্ত হয়েছে বিএনপি। তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তাদের জোটের পরিধি বাড়ানোর চিন্তা করছে। এই দুই রাজনৈতিক জোটেই এমন অনেক দল রয়েছে, যাদের ভোটের মাঠে তেমন কোনো প্রভাব নেই। তারপরও জোটবদ্ধ নির্বাচনের বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জোট রাজনীতির সূচনা হয় ১৯৮০'র দশকের গোড়ার দিকে। এরপর সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় জোট রাজনীতি আরো জোরালো হয়। তখন তিনটি রাজনৈতিক জোট একসাথে সে আন্দোলন করেছিল।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর প্রথম নির্বাচনে সবগুলো দল আলাদা নির্বাচন করলেও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। তখন জামায়াতের সমর্থন ছাড়া বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব ছিল না।

একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও জাতীয় পার্টির সহায়তা ছাড়া সরকার গঠন সম্ভব ছিল না দলটির পক্ষে।

ফলে ২০০১ সালে নির্বাচনী চিত্র পাল্টে যায়। জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে বিএনপি। ব্যাপক সুফল আসে বিএনপির পক্ষে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ করেন, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় বিএনপি জোট করেছিল।

তিনি বলেন, ‘বড় দলগুলোর মধ্যে ভয় কাজ করছে। যদি তারা সরকার গঠন করতে না পারে - এ রকম একটা ভয় থেকে নির্বাচনী জোটের সূচনা।’

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট এবং একপর্যায়ে মহাজোট গঠন করে।

আওয়ামী লীগের জোটে এমন রাজনৈতিক দলও এসেছে যাদের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতার ভিত্তিতে। যেমন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটে একমাত্র জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলোর তেমন কোনো ভোট ব্যাংক নেই।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী ওরফে নওফেলের কাছে প্রশ্ন ছিল- আওয়ামী লীগ অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল হলেও ছোট দলগুলোর সাথে কেন জোট গঠন করেছে?

এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক ছোট রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাব আছে। এক সময়কার আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদ তাদের সাথে এসেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরো বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছি যে আমরা একলা চলো নীতিতে বিশ্বাস করিনা।’

২০০১ সাল থেকেই জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির জোট রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্যদের ভোটের মাঠে তেমন কোন গুরুত্ব নেই বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এ জোটে অনেক দলের নামও জানেন না বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি আরেকটি জোট গঠন করেছে। দলটির সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা মনে করেন, অনেক দলের উল্লেখযোগ্য সমর্থন না থাকলেও এর নানা সমীকরণ রয়েছে।

রুমিন ফারহানা বলেন, ‘পাবলিক পারসেপশান বলে একটা কথা আছে। আমাদের সাথে কতগুলো রাজনৈতিক দল আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’

বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বতাধীন জোটে এমন অনেক দল আছে, যারা এক ব্যক্তি, এক দল হিসেবে পরিচিত। পরিবারের সদস্যদের নিয়েই এসব দল গঠন করা হয়েছে। তাদের কোন অফিস নেই কিংবা কর্মীও নেই।

কিন্তু তারপরেও দেখা যায় বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় বড় দলগুলোর কাছে তাদের কদর বাড়ে এবং তাদের নিয়ে জোটও গঠন করা হয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনাত হুদা মনে করেন, মোটা দাগে জোট গঠনের বিষয়টি প্রতীকী এবং মনস্তাত্ত্বিক।

জিনাত হুদা বলেন, ‘ভোটের রাজনীতিতে এটার কোন প্রভাব নেই। দুই পক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে তাদের সাথে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। একটা জোট থাকলে দলের নেতা-কর্মীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থাকে।’

তবে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ভোটের মাঠে রাজনৈতিক জোট শুধুই প্রতীকী ব্যাপার নয়। কখনো-কখনো এর বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। এমন অবস্থায় তিনি সম্প্রতি গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উদাহরণ টানেন।

রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, দু-একটা রাজনৈতিক দল আছে যাদের ভোট ব্যাংক না থাকলেও নেতাদের ব্যক্তি ইমেজ আছে। রাজনৈতিকভাবে তাদের তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও, সামাজিক কিছু গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বড় রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচনী জোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। জোটের শরীক দলগুলো থেকে সরকারের অংশীদারও করা হচ্ছে।

২০০১ সালে বিএনপি যেমন মন্ত্রীসভায় জামায়াতে ইসলামীকে স্থান দিয়েছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগও সরকারের অংশীদার করেছে জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি এবং সাম্যবাদী দলকে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, জোট রাজনীতি তাদের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, ‘জোট থাকলে যেটা হয় যে অনেক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কাছাকাছি রাজনৈতিক মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর ইনপুট থাকে।’

বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা মনে করেন, জোটবদ্ধ রাজনীতি ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা তৈরি করে দিচ্ছে।

‘এমন অনেক ছোট-ছোট রাজনৈতিক দল আছে যারা আদর্শ-ভিত্তিক রাজনীতি করতে চায়, তারা হয়তো পার্লামেন্টে ভয়েস রেইজ করার সুযোগ পেতো না। তারা যখন বড় দলের সাথে যুক্ত হয়, তখন তাদের ভয়েসটাও মানুষ শুনতে পায়,’ বলছিলেন রুমিন ফারহানা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জোটবদ্ধ নির্বাচনের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাবে।

কারণ, এককভাবে নির্বাচন করে কোনো দল ক্ষমতায় যেতে পারবে কিনা সে সংশয় রয়ে গেছে অনেক পর্যবেক্ষকের মনে।

নিউজওয়ান২৪/এমএস

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত