ঢাকা, ৩১ মে, ২০২৫
সর্বশেষ:

‘শুভ নববর্ষ’

নতুনের কেতন উড়িয়ে এলো বৈশাখ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:৪২, ১৪ এপ্রিল ২০১৯  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। 

উৎসবের রঙ ছড়িয়ে এসেছে পহেলা বৈশাখ। প্রকৃতির সবখানেই যেন নতুন সুর। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব আজ। বিশ্বজুড়ে বাঙালি আজ মেতে উঠবে আনন্দে-উচ্ছ্বাসে। 

ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ একযোগে গাইবে, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। সব গ্লানি মুছে নবোদ্যমে শুরু হবে পথচলা। স্বাগত ১৪২৬। শুভ নববর্ষ।

নববর্ষ এক আনন্দোৎসব। কেননা, তা আসে নতুন আশা নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে, নতুন প্রত্যয় নিয়ে। সব অশুভ ও অসুন্দরকে পেছনে ফেলে বৈশাখ আসে নতুনের কেতন উড়িয়ে।

আজ নতুন বছরকে বরণ করে নেবে বাঙালি। নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক। নতুন হালখাতা খুলবে ব্যবসায়ীরা। নববর্ষ বরণে রাজধানীসহ সারাদেশ একযোগে চলবে লোকজ ঐতিহ্যের নানা উৎসব অনুষ্ঠান। মাঠে-প্রান্তরে, শহর-নগরে, গ্রাম কিংবা নদীপারে সবাই মিলিত হবে উৎসবে। কোটি প্রাণের চাঞ্চল্য আর উৎসব-মুখরতায় সুর উঠবে বাঁশির, বেজে উঠবে ঢোল-বাদ্য।

ভোর থেকে পথে পথে ঢল নামবে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষের। তাদের পরনে থাকবে লাল-সাদার পাশাপাশি বাহারি রঙের নকশাদার পোশাক।

মেলা বসবে পার্কে কিংবা কোনো খোলা জায়গায়। নানা গ্রামীণ পসরা নিয়ে বসবে দোকানিরা। বাবা কিংবা কাকা-মামার কাঁধে চড়ে শিশুটি কিনবে ঢুগঢুগি কিংবা হাতি-ঘোড়া খেলনা। কিশোরী-তরুণীরা লাল চুড়িতে ভরবে হাত।

বছরের প্রথম দিনটিতে বাসাবাড়িতে তৈরি হবে বাঙালি খাবার-শুঁটকি-বেগুন-ডাল-আলু-কালিজিরাসহ নানা পদের ভর্তা।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ রোববার সরকারি ছুটি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করছে বিশেষ সংখ্যা। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
 
কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্র্রসন ও বাংলা সৌরসন ভিত্তি করে প্রবর্তন হয় নতুন এই বাংলা সন।

১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।

পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।

আজ রাজধানীর সব পথ মিলবে রমনা বটমূলে। বহু বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও রাজধানীর রমনা বটমূলে আয়োজন করা হবে বর্ষবরণ উৎসবের। এখন এটি পয়লা বৈশাখের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান।

প্রকৃতির সান্নিধ্যে ভোর সোয়া ৬টায় শুরু হবে ছায়ানটের অনুষ্ঠান। পয়লা বৈশাখ ভোর সোয়া ছয়টায় যন্ত্রসঙ্গীতে ভোরের আলাপ তুলে শুরু হবে বৈশাখ আবাহন।

দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে এবারো পয়লা বৈশাখ সকালে এই শোভাযাত্রা বের করা হবে। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে ফের এটি চারুকলায় এসে শেষ হবে। এতে গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছেন আয়োজক চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন সব শ্রেণি-পেশার, বয়স, বর্ণের মানুষ।

এবার সরকারি উদ্যোগে দেশের সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বৈশাখী র‌্যালি আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সব জেলায় কুইজ প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ মেলার আয়োজন করছে স্থানীয় প্রশাসন। 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ  শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বিসিক নববর্ষ মেলা, আলোচনাসভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশ ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট/একাডেমিগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠান রেখেছে।

বাংলা নববর্ষে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের রয়েছে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। সব জাদুঘর ও প্রত্নস্থান সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে এবং শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী, প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের বিনা টিকিটে প্রবেশ করতে পারবে।

স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। অভিজাত হোটেল ও  ক্লাব বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের আয়োজন রয়েছে।

সব সরকারি/বেসরকারি টিভি, বাংলাদেশ বেতার, এফএম ও কমিউনিটি রেডিও বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে। বাংলা নববর্ষের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি চ্যানেলগুলো রমনা বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করছে।

জাতীয় প্রেসক্লাব বর্ষবরণে তাদের সদস্য ও পরিবারবর্গের জন্য সকাল থেকেই খৈ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা ও বাঙালি খাবারের আয়োজন রেখেছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিও অনুরূপ আয়োজন রেখেছে তাদের সদস্য ও পরিবারের সদস্যদের জন্য।

বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা চাঁদরে। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় এ উপলক্ষে সারাদেশেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করছে সব সংস্থা। সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোস্ট ও চেক পোস্ট। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।

চাই পান্তা-ইলিশ: কেউ কেউ বলেন বটে-পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের খুব সম্পর্ক নেই; ছিল না। কিন্তু তাতে কী? রাজধানী শহরে পহেলা বৈশাখ মানেই যেন পান্তা-ইলিশ। শুঁটকি ভর্তা, আচার ইত্যাদি দিয়ে মজা করে খাওয়া হবে আজ। ঘরে, বিভিন্ন মেলায়, উৎসবে আয়োজন থাকবে পান্তা-ইলিশ। তবে দাম বেশি, অগ্নিমূল্য।

শুভ হালখাতা: চৈত্রের শেষ দিনে শনিবার ব্যবসায়ীরা পুরনো বছরের বিকিকিনির সব হিসাবনিকাশ চুকিয়ে দিয়েছেন। আজ পয়লা বৈশাখে তারা হালখাতা খুলবেন। নবোদ্যমে শুরু করবেন ব্যবসা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঐতিহ্য ধরে রাখতে ঢাকায় এখনো হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে স্বর্ণকার ও কাপড় ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের আগে থেকেই গ্রিটিংস কার্ডের মাধ্যমে বা সরাসরি নিমন্ত্রণ জানান।

নিউজওয়ান২৪.কম/আ.রাফি

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত