ঢাকা, ২৮ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ:

এবার আ. লীগের দুই সহোদর নেতার বাড়িতে ‘টাকার খনি’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:০০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর সূত্রাপুরে এবার আওয়ামী লীগ দুই সহোদর নেতার বাড়ি থেকে জব্দ করা হলো বিপুল অঙ্কের টাকা, স্বর্ণালংকার ও অস্ত্র।

দুই  নেতার বাড়ি থেকে পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, আট কেজি স্বর্ণালংকার ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব। 

নিজেদের বাড়িতে সব টাকা রাখার জায়গা না থাকায় তারা অনেক টাকা বন্ধু ও কর্মচারীর ফ্ল্যাটেও রাখেন। এমনকি অস্ত্রও রেখেছেন কর্মচারীর বাসায়। কোটি কোটি টাকার বান্ডেল সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা বানিয়েছিলেন লোহার ভল্ট। তার পরও এত নগদ টাকা রাখতে সমস্যা হওয়ায় তারা স্বর্ণালংকার কিনে রাখা শুরু করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোভাবেই তাঁদের কাছে এসবের সুরক্ষা হয়নি। 

মঙ্গলবার সকালে র‌্যাবের অভিযানে পুরান ঢাকার তিনটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অবৈধভাবে কামানো এসব অর্থ ও স্বর্ণালংকার। তিনটি বাড়িতে লোকজন থাকলেও তাদের কাউকে আটক করা হয়নি। তবে তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে র‌্যাব। 

আলোচিত এই দুই নেতার একজনের নাম এনামুল হক এনু, অন্যজন রূপন ভুঁইয়া। তারা সহোদর। এনু গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, আর রূপন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দুজনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব। তবে জানা গেছে, গত সপ্তাহে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন এনু। আর রূপনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে র‌্যাব। র‌্যাব জানিয়েছে, দুই ভাই ক্যাসিনোচক্রের হোতাদের অন্যতম। 

এদিকে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত ও অবৈধ সম্পদ লেনদেনের অভিযোগে এনবিআরের নির্দেশনায় এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী এবং যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য গতকাল বিভিন্ন ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ঠিকাদার জি কে শামীমকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে গণপূর্তের দুই প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম ও আব্দুল হাইয়ের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে এনবিআর। 

গতকাল সকাল ১০টার দিকে প্রথমে র‌্যাব-৩-এর একটি দল সূত্রাপুর থানাধীন কাঠেরপুল লেনের ৩১ নম্বরের ছয়তলা বাড়িতে অভিযান চালায়। এটি এনু ও রূপনদের নিজেদের বাড়ি। ভবনটির তিনতলায় ও পাঁচতলার ফ্ল্যাটের ভল্টের ভেতর থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, আট কেজি স্বর্ণালংকার ও পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। পরে র‌্যাব খবর পায়, তাঁদের আরো টাকা ও অস্ত্র আছে নারিন্দার দুটি বাড়িতে। এরপর ৮২/১ নারিন্দা লালমোহন স্ট্রিটের দোতলায় এনুর কর্মচারী আবুল কালাম ওরফে কালার নিজস্ব ফ্ল্যাট থেকে দুই কোটি টাকা ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এরপর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শরত্গুপ্ত রোডের ২১/১/এ নম্বর দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে একটি লকার থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। এ বাড়ির মালিক হারুনুর রশীদ। তিনি এনুর বন্ধু বলে জানিয়েছেন হারুনের স্ত্রী নাদিয়া শারমিন লিপি।

সংবাদমাধ্যমকে লিপি বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে মাদরাসায় পড়ে। আমি ওকে আনতে মাদরাসায় বেশির ভাগ সময় কাটাই। কবে ভল্ট এনেছে সে বিষয়ে কিছু জানি না।’ অভিযানের সময় হারুনুর রশীদ বাসায় ছিলেন না। তাকেও খুঁজছে র‌্যাব।

এনুদের কাঠের পুল লেনের বাড়িতে অভিযান শেষে দুপুরে ওই বাড়ির সামনেই র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ বুলবুল সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, টাকা ও সোনা রাখতে ইংলিশ রোড থেকে পাঁচটি ভল্ট ভাড়া করা হয়েছে। এই সূত্র ধরে ৩১ নম্বর বানিয়ানগরের কাঠেরপুল লেনের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। ওই বাড়ির তৃতীয় ও পঞ্চম তলায় তিনটি ভল্ট পাওয়া গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সকালে অভিযান শুরুর পর ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভল্টগুলো খোলা হয়। তিনটি ভল্ট থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ নগদ টাকা, আট কেজি বা ৭৩০ ভরি সোনার অলংকার উদ্ধার করা হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য চার কোটি টাকা। বাসাটি থেকে পাঁচটি অস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব।’ প্রতিটি ভল্ট থেকে উদ্ধার করা সবটাই ছিল এক হাজার টাকার নোট।

র‌্যাব সূত্র জানায়, এনামুল হক এনু ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অংশীদার। সেখান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে সোনা কিনে ভল্টে লুকিয়ে রাখতেন তিনি। নগদ টাকা রাখতে বেশি জায়গার প্রয়োজন হওয়ায় তিনি সোনা কিনে রাখতেন। তার ভাই রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়েরও অভিযোগ রয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ গতকাল বিকেলে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘খবর নিয়ে জানলাম এনামুল হক গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর তার ভাই রুপন ভুঁইয়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আমরা আগে পাইনি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তাদের উত্থান যেভাবে : এনু ও রুপনের বাবার নাম সিরাজ মিয়া। ৩০ বছর আগে তাদের বাবার ক্লাবপাড়ায় ব্যবসা ছিল। ১০ বছর আগেও তারা ওয়ারী এলাকায় মুসুন্দি বাজারে পৈতৃক ভিটায় টিনশেডের বাসায় থাকতেন। ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রশীদুল হক ভুঁইয়ার মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করেন। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও যুবলীগ নেতা নুরন্নবী শাওনের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। এরপর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে তারা রাজধানীতে অন্তত ১৫টি বাড়ির মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। 

কাঠের পুলের যে বাড়ি থেকে অস্ত্র, টাকা ও স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে, সেই বাড়ির জমি কিনে তিন বছর আগে ছয়তলা ভবনের কাজ শুরু করেন দুই ভাই। তিন মাস আগে ভাড়াটিয়াসহ দুই ভাই এই বাড়িতে ওঠেন। পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকেন এনু ও পাঁচতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন রুপন। তাদের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর ও গেণ্ডারিয়া এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করারও অভিযোগ রয়েছে।  এ ছাড়া তারা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবেও ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাতে থাকেন। এলাকার লোকজন জানায়, সূত্রাপুর ও গেণ্ডারিয়া এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি তৈরি করতে গেলে বা ফ্ল্যাট কিনতে গেলে তাদের চাঁদা দিতে হতো।

সরেজমিন : গতকাল দুপুরে এনুদের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক উত্সুক জনতার ভিড়। বাড়িটি ঘিরে আছে প্রায় অর্ধশত র‌্যাব সদস্য। সাধারণ মানুষ বলাবালি করছিলেন, এই আওয়ামী লীগ নেতাদের দাপটে এলাকার মানুষ অশান্তিতে আছে। চাঁদা না দিলেই গুলি করে এঁরা।

উপস্থিত লোকদের একজন জানান, এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান হলেই তাদের চাঁদা দিতে হয়। কেউ যদি ফ্ল্যাট বা জমি কেনে তাহলেও তাদের লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসব বিষয়ে পুলিশকে জানিয়ে কোনো লাভ না হওয়ায় কেউ অভিযোগ করতে সাহস পেত না। এলাকাবাসী এই অভিযানের কারণে বেশ খুশি।

এনুর কর্মচারী আবুল কালাম আজাদের বাড়িতে অভিযান চালানোর সময় গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও সরু গলিতে মানুষের ভিড়। এলাকাবাসী জানায়, আবুল কালাম একটি ওয়ার্কশপের কর্মচারী ছিলেন। পাঁচ বছর আগে ওয়ার্কশপটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে এনুর মাধ্যমে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে চাকরি নেন কালাম। এরপর তার দিনও ফিরে যায়। কিনে ফেলেন একটি ফ্ল্যাটও। গতকাল অভিযানের আগে পালিয়ে যান তিনি।

অন্যদিকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে অভিযান চালানো হয় নারিন্দায় হারুনুর রশীদের বাড়িতে। অভিযানের আগেই হারুন পালিয়ে যান। তার স্ত্রী নাদিয়া শারমিন লিপি সংবাদমাধ্যমকে জানান, তার স্বামী সকাল থেকেই বাসায় নেই। বিকেলের দিকে র‌্যাব আসে। র‌্যাব তার কাছে ভল্টের চাবি চায়। কিন্তু তিনি জানান, চাবি তার স্বামীর কাছে। পরে র‌্যাব তালা ভেঙে দুই কোটি টাকা জব্দ করে। এক হাজার টাকার নোটে ঠাসা ছিল ভল্টটি।

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত