ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ, ১৯ ডিসেম্বর অস্ত্রসমর্পণ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯  

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ছবি: সংগৃহীত

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে-পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মূল দুশ্চিন্তা ছিল নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। তারা শঙ্কিত ছিল, নয় মাসের গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের কারণে ক্রুদ্ধ মুক্তিবাহিনী আর জনতা তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে।

১৬ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়াজির মধ্যে আত্মসমর্পণ চুক্তি নিয়ে যখন দর কষাকষি চলছে, তখন পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা ছিল আলোচনার একটা বড় বিষয়। ঢাকায় তখন পাকিস্তানি সৈন্য আর নানা রকম আধাসামরিক বাহিনীর লোকজন মিলিয়ে ৯৪ হাজার সদস্য আটকা পড়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তাঁর স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব আ নেশন বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ না করে সেনানিবাসে তাঁর সদর দপ্তরেই আত্মসমর্পণের ব্যাপারে চাপাচাপি করছিলেন।সেটা যে কেবল জনসমক্ষে অবমাননা এড়ানোর জন্য, তা নয়। এর পেছনে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর চিন্তাও কাজ করেছিল।

এই ভীতি যে খুব অমূলক ছিল, তাও নয়। কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) তার স্বাধীনতা ’৭১ বইয়ে লিখেছেন, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর নিয়াজিকে বহনকারী গাড়ি যখন লাখ লাখ জনতার ভিড় ঠেলে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগোচ্ছিল, তখন একাধিকবার সেই বহরের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত জনতা নিয়াজিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা বলছিল, ‘নিয়াজিকে আমাদের হাতে দাও। ও খুনী। ও আমাদের লক্ষ লক্ষ লোক মেরেছে, আমরা ওর বিচার করব।’

জ্যাকব লিখেছেন, আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনায় সাব্যস্ত হয়, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হলেও নিয়াজি ও তার বাহিনী তখনই অস্ত্র সমর্পণ করবে না। জেনারেল জ্যাকব ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবন্দী হলেও ঢাকা সেনানিবাসে তাদের অবস্থান ছিল সশস্ত্র। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।

হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক), দুই নম্বর সেক্টরের গেরিলা এবং কে ফোর্সের সদস্য, সে সময় ছিলেন ঢাকায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যদের এই ভীতি খুব অবাস্তব ছিল না। তারা জানত, তাদের কৃতকর্ম বাঙালিরা কখনো ক্ষমা করবে না। পাকিস্তানি বাহিনীকে সামনাসামনি পেলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আস্ত রাখত না।’

তিন দিন পর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের গলফ মাঠে অস্ত্র সমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্য। তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। মিত্রবাহিনীর পক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সগৎ সিং অস্ত্র গ্রহণ করেন।

পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক পার্থ সেনগুপ্ত ছিলেন এই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে। পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রতিবেদনে ১৯ ডিসেম্বরের ডেট লাইনে তিনি লিখেছেন, ‘অফিসারস হুশিয়ার! হাতিয়ার বাহার জমিন! পাকিস্তানি স্থল বাহিনীর মেজর জেনারেল জামসেদ কম্যান্ড দেবার সঙ্গে আজ বেলা ১০টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গলফ মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর ৪৭৮ জন পাকিস্তানি অফিসার তাদের অস্ত্রগুলি সাজিয়ে রাখলেন। তারপর এক পা পিছিয়ে গিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার গিয়ে অস্ত্রগুলি কুড়িয়ে নিলেন। নানান ধরনের অস্ত্র, পিস্তল, রিভলবার, এলএমজি, স্টেনগান।
‘ডিসেম্বরের সূর্যের দিকে মুখ করে ম্রিয়মাণ বিষণ্ন²মুখে ক্যানটনমেনটের দিকে তাকিয়েছিলেন পাক বাহিনীর দীর্ঘতম লে. জেনারেল ফরমান আলি। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যানটনমেনটের বিভিন্ন ইউনিট লাইনে তাঁর বাহিনীর ৩০ হাজার পরাজিত সৈন্য নিজেদের হাতিয়ার তুলে দিচ্ছে। আজ থেকে বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ পাক সৈন্য ভারতের যুদ্ধবন্দী।’

সাংবাদিক পার্থ সেনগুপ্ত লিখেছেন, অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে রাও ফরমান আলি বিমর্ষ থাকলেও তার সৈন্যরা মনে মনে খুশিই ছিলেন। কারণ অস্ত্র সমর্পণ মানে এখন তাঁরা জেনেভা কনভেনশনের আওতায় এলেন। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয় দূর হয়েছে।

জেনারেল নিয়াজি এই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না। আগের দিন তাঁকে হেলিকপ্টারে করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত এক প্রতিবেদনে জানান, ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সেনানিবাসে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। অস্ত্রধারী পাকিস্তানি সৈনিকেরা তাদের ব্যারাক থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কর্নেলকে হত্যার চেষ্টা করলে প্রচণ্ড উত্তেজনা দেখা দেয়। মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশপথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কর্তৃপক্ষ তাদের নিবৃত্ত করে। এ ঘটনার পটভূমিতে ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে।

সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত লিখেছেন, অস্ত্র সমর্পণের পরও তিনি কিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে সেনানিবাস এলাকায় অস্ত্র হাতে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন।

যুগান্তর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা গ্যারিসনে প্রায় এক হাজারের মতো অফিসার থাকলেও সংক্ষিপ্ত সেই অনুষ্ঠানে অস্ত্র সমর্পণ করেন চার শর কিছু বেশি অফিসার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বকারী জেনারেল সগৎ সিং তাঁর ভাষণে বলেন, তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বলাটা ‘কষ্টকর’। তবে প্রত্যেক খেলারই কিছু নিয়ম আছে, যুদ্ধেরও আছে। সগৎ সিং জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীরা কী কী সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করবেন, তা ঘোষণা করেন।

সূত্র: প্রথম আলো

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত