ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

এমপি মাশরাফির ‘বাউন্সারে’ ওএসডি ৪ ফাঁকিবাজ ডাক্তার

প্রকাশিত: ১১:২২, ২৯ এপ্রিল ২০১৯  

আবর্জনায় ভরা হাসপাতালের আঙ্গিনা দেখেও চরম বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হন এমপি মাশরাফি

আবর্জনায় ভরা হাসপাতালের আঙ্গিনা দেখেও চরম বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হন এমপি মাশরাফি

নড়াইল জেলা সদর হাসপাতালের চার চিকিৎসককে বিনা অনুমতিতে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির দায়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া কারণ দর্শানোর নোটিশও জারি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি নড়াইল-২ আসনের এমপি ও জাতয়ি ক্রিকেট দলের ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মুর্তজা আকস্মিক ওই হাসপাতালে গিয়ে রুগিদের সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত চিকিৎসকদের অনুপস্থিত পান। তার জের ধরে ফাঁকিবাজ ওই চিকিৎসককের বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো।

প্রসঙ্গত, টাইগারদের জনপ্রিয় এবং সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার বেড়ে ওঠা ও বসবাস নড়াইলে। আর নড়াইল শহরেই জেলা সদর হাসপাতাল অবস্থিত।সম্প্রতি মাশরাফি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে ডাক্তারদের না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন- এমন একটি ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়। তিনি কর্তব্যে নিয়োজিত চিকিৎসকদের না পেয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এবং সার্জারির একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে কৈফিয়ত তলব করেন।

শাস্তির খাড়ায় পড়া চিকিৎসকরা হলেন, নড়াইল সদর হাসপাতালের সার্জারির সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আখতার হোসেন, কার্ডিওলজির জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শওকত আলী ও ডা. রবিউল আলম এবং মেডিকেল অফিসার ডা. এ এসএম সায়েম।

গতাল রবিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত চিকিৎসকদের ওএসডি করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগ দিতে বলা হয়েছে।

তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে পাঠানো কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, আপনি গত ২৪ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। আপনার উক্ত কার্যকলাপ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ মোতাবেক অসদাচরণের শামিল। আপনার এহেন আচরণের বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা অত্র পত্র প্রাপ্তির তিন কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদান করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।

ভিডিওতে সার্জনের সঙ্গে মাশরাফিকে সেলফোন কথোপকথনে বলতে শোনা যায়, আপনি বাসায় গেছেন কেন স্যার? আপনি সেটা আমাকে বুঝাই বলেন! আপনার থাকার কথা নড়াইলে। আজকে যদি এই হসপিটালে কোনো একটা পেশেন্টের সার্জারি প্রয়োজন হয়, আপনি কি সুন্দর বলতেছেন রবিবারে আসেন, আমি রবিবারে সার্জারি করব! তা এই দুদিন আপনার জন্যে পেশেন্ট পড়ে থাকবে? 

মাশরাফি তাকে আরো বলেন, এখন আপনি বলেন, আপনার কী করব, বলেন? বলেন আপনিই বলেন, আপনারে আমি কী করব বলেন? কী হল কথা বলেন না কেন?

ওই প্রান্তের কথা ভিডিওতে বোঝা না গেলেও এ প্রান্তে মাশরাফি বলতে থাকেন, আপনি ফাইজলামি শুরু করছেন? আজকে যদি একটা পেশেন্টের প্রয়োজন হয় সার্জারি করার কাকে দিয়ে সার্জারি করাবে? আপনি কি এটা ভাবেননি একবারও?

নড়াইল সদর হাসপাতালের রোগীদের অভিযোগের ফিরিস্তি শুনে খুবই অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল এমপি মাশরাফিকে। (ছবি: সংগৃহীত)

জনগণ খুশি, ফাঁকিবাজদের মুখে চুনকালি
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ওই পরিদর্শনে হাসপাতালের নানা স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন এমপি মাশরাফি। তখন এক অন্য মূর্তি তার। যেন টাইগার ক্যাপ্টেন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন দুর্নীতি আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার উইকেট উপড়ে ফেলার জন্য।

শামিম নামে স্থানীয় একজন ছাত্র বললেন, এমপি সাহেবরা যে এমন সংহার রূপ ধারণ করতে পারেন এটা বিশ্বাসই করতে চায় না নড়াইলবাসী। কারণ, আমরা এরকম আগে দেখিনি। এমপিদের শুধু দেখেছি তেল মাখানো হাসি দিয়ে চেলা-চামুণ্ডাদের সহযোগে লোকদেখানো কর্মকাণ্ড করতে। তারা অনেক অন্যায়-দুর্নীতি ঢেকে রেখে ‘সব ঠিক আছে’ দেখানোয় ব্যস্ত থাকতেন।

এমপির হাসপাতালে আসা দেখে উপস্থিত সাধারণ মানুষের মধ্যে এসময় আনন্দের হাসি থাকলেও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তারা নিজেদের দোষ ঢাকতে তখন মহাব্যস্ত। হাসপাতালে আবর্জনাপূর্ণ ড্রেন এবং পুঁতিগন্ধময় নোংরা পরিবেশ দেখে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের কাছে কারণ জানতে চান মাশরাফি। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মশিউর রহমান এসময় নড়াইল পৌরসভার ওপর দায় চাপিয়ে কোনোরকমে রকমে রেহাই পান। এসময় উপস্থিত দুই চিকিৎসক এবং কর্মকর্তারা মাশরাফির কাছে এই সকল ঘটনার খবর না ছাপানোর জন্য অনুরোধ করেন। হাসপাতালের সংক্রামক ওয়ার্ডে গেলে রোগীরা নানা অভিযোগ করেন সংসদ সদস্য মাশরাফির কাছে। ‘বাইরে থেকে স্যালাইনও কিনে আনতে হয়’- এই অভিযোগ শুনে তিনি হাসপাতালের বাইরের দোকানগুলোতে সরকারি স্যালাইন পাওয়া যায় কিনা এটা দেখার জন্য  নির্দেশ দেন। হাসপাতালের ঔষধ সংকট শুনে স্টোর কিপারকে ডাকেন। তবে কিপারও খন ছিল না। পরে তাকে না পেয়ে রাতে আবার সভা করবেন বলে বেরিয়ে যান।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সাধারণ মানুষের পকেট থেকে দেয়া সরকারের বেতন খাওয়া চিকিৎসকদের এমন স্বোচ্ছাচারিতার প্রতিকারে ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেন মাশরাফি। হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে ওই সভায় জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা, পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুর, সিভিল সার্জন ডা. আসাদ-উজ-জামান মুন্সি, হাসপাতালের আরএমও ডা. মশিউর রহমান বাবু উপস্থিত ছিলেন।

সভায় বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেন মাশরাফি-বিন মর্তুজা এমপি। সেগুলো হচ্ছে-

* যেসব চিকিৎসক হাসপাতালে সময়মতো আসনে না এবং অনুপস্থিত থাকেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

* হাসপাতালে প্যাথলজিক্যাল সেবা যতটা দেওয়া সম্ভব তার সবটুকু যেন সাধারণ রোগী পান।

* সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসকদের হাসপাতালে অবস্থান করতে হবে।

* হাসপাতালের দুটি অ্যাম্বুলেন্স বাদে প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের ভিতরে থাকতে পারবে না।

* কোনো দালাল চক্র হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারবে না।

* সব রোগী যাতে সরকারি ওষুধ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

* বড় বড় ওয়ার্ডে দুজন করে নার্স দিতে হবে।

* জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালের জেনারেটর চালু রাখতে হবে।

এসবের কোনোটি ঠিকঠাক মতো না হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন এমপি মাশরাফি বিন মুর্তজা।

গাফিলতি আগেই নজরে পড়েছিল!
এদিকে এমপি মাশরাফির হাসপাতাল পরিদর্শন ও সেখানকার নানান অব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়ে সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুর তিনি গত বুধবার(২৪ এপ্রিল) এই হাসপাতালে যোগদান করেছেন। তিনি আরো বলেন, আমি  এখানে  এসেই কয়েকজন চিকিৎসকের গাফিলতি লক্ষ্য করেছি। এমপি সাহেব যেভাবে আজ দেখলেন,আর যা বললেল তাতে আমার কাজটি অনেক সহজ হয়ে  গেলো, এখন আর কেউ আমার বিরুদ্ধে দল পাকাতে পারবে না।

অপরদিকে, সংসদ সদস্য মাশরাফি হাসপাতাল পরিদর্শন প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের একটি  হলো  চিকিৎসা। এই সেবার মান নিশ্চিত করতে আমার যা কিছু করার আমি সবই করবো। কিছু মানুষের জন্য নিরীহ জনগণ কষ্ট পাবে এটা কেউই সহ্য করবে না।

নিউজওয়ান২৪.কম/আরকে 

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত