ঢাকা, ০৩ মে, ২০২৪
সর্বশেষ:

একুশে গ্রন্থমেলার হালচাল (চতুর্থ দিন)

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:০০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

অমর একুশে গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিন আজ সোমবার। বিকাল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা, দর্শনার্থী এবং লেখকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাণের মেলা। 

তবে প্রতিদিনই মেলায় আসা শত শত বই পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারছে না। মূলত মানসম্মত সৃজনশীল বইই খুঁজে ফিরছেন পাঠক। মেলায় প্রচুর বই থাকলেও মানের বই নেহায়েতই কম বলছেন অনেকেই। প্রকাশক লেখকরাও বিষয়টি স্বীকার করছেন।

চতুর্থ দিন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক বই এসেছে মেলায়। তবে এসব বইয়ের মধ্যে খুব কম বইই আছে যা পাঠককে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। আবার বইগুলোর মধ্যে অধিকাংশই কবিতার।

প্রতিষ্ঠিত লেখকরা বলছেন, বর্তমানে লেখকরা কম পড়ে বেশি বই প্রকাশ করতে চান। আর এ কারণে তাদের কলম দিয়ে ভালো লেখা বের হয় কম। এছাড়া যারা সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন তারাও সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারছেন না।

তবে যারা বইয়ের মূল্যায়ন করবেন সে পাঠকরা এতকিছু বিচার করতে চাননা। একাধিক পাঠকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মানসম্মত লেখা চান। তবে সে লেখা লেখক কিভাবে লেখেন আর প্রকাশক কিভাবে সম্পাদনা করেন তা বিচার করতে চাননা তারা। মূলত সৃজনশীল, তথ্যবহুল, ঐতিহাসিক, জীবনমুখি বা ফিকশনধর্মী বইই বেশি চান পাঠক। বিক্রিতেও এই বইগুলো এগিয়ে আছে। তবে বাজারে আসা বইয়ের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে কবিতার বই।

উৎস প্রকাশনার প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বলেন, পাঠকতো অবশ্যই ভালো লেখা চাইবে। তবে এখন বইমেলায় চার পাঁচ হাজার করে বই আসলেও পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো বই আসছে কম। এর কারণ হলো লেখকরা এখন অনেক বেশি নগর কেন্দ্রীক। তারা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেননা। গ্রামের মানুষের কথা লেখনীতে আনেন না। যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আখতারুজ্জামনা ইলিয়াস, শরৎ বা হূমায়ুন আহমেদ তাদের লেখায় কুলি, মজুর, মেথর, চাষিদের নিয়ে লিখে মহান হয়েছেন। কিন্তু এখনকার বেশিরভাগ লেখকই সমাজের উচুশ্রেণীর মানুষদেরকে নিয়ে লিখে থাকেন। এ কারণে তারা আজ গণমনুষের কাছে পৌঁছাতে পারেননা।

কবি তিথি আফরোজ বলেন, একজনকে লেখক হওয়ার আগে প্রচুর পড়তে হবে। একজন লেখকের লেখা দেখলে বুঝা যায় তিনি কতটা পড়ে থাকেন। বেশি পড়লে বেশি ভালো লেখা সম্ভব। আর তার মধ্যদিয়েই একজন লেখক পাঠকের কাছে যেতে পারেন। এছাড়া যারা সম্পাদনা করেন তারাও এখানে একটা বড় ভূমিকা রাখেন। তারা যদি ভালো গাইড করতে পারেন তবে সেটাও বেশ কাজে দেয়।

মেলা শুরুর পর গত কয়েকদিন ধরে পাঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা তাদের মনমতো বই কমই পাচ্ছেন। আবার অনেকে জানিয়েছেন, তারা বই কিনবেন পরে। আগে ভালো মানের বই বেছে রাখছেন। আর এ জন্য প্রায় প্রতিদিনই তারা আসছেন মেলায়।

মতিঝিল থেকে আসা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হাবিব বলেন, আমি তিনটি ইতিহাসের বই কিনেছি। দু একটি প্রবন্ধের বই কিনবো তবে ও রকম বই তো খুজেই পাচ্ছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের হাসান বলেন, কবিতার বই দিয়ে ঢেকে গেছে মেলা। অন্যান্য বই কমই দেখছি। এটা আমাকে খুবই হতাশ করেছে।

লেখক বলছি কর্ণার: এ বছর ভালো মানের ৫ জন লেখককে ২০ মিনিট করে নিজের বই নিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে মেলা আয়োজক কর্তৃপক্ষ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেক পাড়ে ‘লেখক বলছি’ কর্ণারের এ আয়োজনে সোমবার নিজেদের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে আলাপনে অংশ নেন গিরিশ গৈরিক (বই: বৈঠকখানায় কবি), জাকির তালুকদার (বই: গল্পের জার্নাল), তিথি আফরোজ (বই: তিথির তিরিশ), নাসিমা আনিস (বই: বৃহন্নলা বৃত্তান্ত) এবং বিধান রিবেরু (বই: চলচ্চিত্র বোধিনী)। প্রত্যেকেই তাদের বইয়ের ওপর ২০ মিনিট  করে কথা বলেন। এরপর চলে পাঠক প্রশ্নত্তোর পর্ব। নিজের বই সম্পর্কে কবি তিথি আফরোজ জানান, আমি আমার লেখার মধ্য দিয়ে মূলত মানুষের সংকট, সংকীর্ণতা, বহুরূপী প্রবণতা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

মেলার চতুর্থ দিনে নতুন বই: বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্য মতে মেলার চতুর্থ দিনে বই প্রকাশিত হয়েছে ১৪১টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো:- গ্রন্থ কুটির এনেছে মোহীত উল আলমের উপন্যাস ‘মুরলী’, জ্যোতি প্রকাশ এনেছে ড. তপন বাগচীর সমালোচনা গ্রন্থ ‘মহসিন হোসাইনের কবিতার বিষয় ও শরীরী নির্মণ’ হাওলাদার প্রকাশনী এনেছে নীরা কাদরীর আবৃত্তির বই ‘আবৃত্তির নির্বাচিত কবিতা’, পালক পাবলিশার্স এনেছে কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের প্রবন্ধ ‘অবস্থা বদলের জন্য ব্যবস্থা বদলের সন্ধানে’, নাগরী এনেছে আবু হাসান শাহরিয়ারের কাব্যগ্রন্থ’ ‘বিমূর্ত প্রণয়কলা, অন্যপ্রকাশ এনেছে শিহাব শাহরিয়ারের কাব্যগ্রন্থ ‘পড়ে থাকে অহংকার, ইমদাদুল হক মিলনের গল্পের বই ‘ফেলে যাওয়া রুমালখানি, নাসরীন জাহানের উপন্যাস ‘সিসেমের দ্বিতীয় দরজা, পাঞ্জেরী এনেছে সাইফুল্লাহ মাহমদু দুলালের কবিতার বই ‘প্রেমের আগেই পড়েছি বিরহে’, নবযুগ প্রকাশনী এনেছে সনজীদা খাতুনের প্রবন্ধ ‘নজরুল মানস’, অনন্যা এনেছে কনক চাঁপার গল্পের বই ‘কাঁটাঘুড়ি-২. সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই ‘নায়লন গোলাপ টেবিলে’ মোস্তফা মামুনের কিশোর উপন্যাস ‘রাজু ভাই-মাইনাস শেলী আপা’ ইত্যাদি।

বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. নূহ-উল-আলম লেনিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সুভাষ সিংহ রায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তোফায়েল আহমেদ এমপি।

স্বাগত বক্তব্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, আজকের আলোচনা অনুষ্ঠানটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দাবি রাখে কারণ ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ এ অনুষ্ঠানে জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করার বিষয়ে বক্তব্য রাখতে উপস্থিত হয়েছেন।

প্রাবন্ধিক বলেন, ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৬৯-এ ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে তোফায়েল আহমেদ যখন শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন তখন মঞ্চে উপস্থিত ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও ডাকসুসহ সকল ছাত্র নেতৃবৃন্দ রেসকোর্সের লক্ষ জনতার সাথে দু-হাত তুলে এই ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানান।

তিনি আরো বলেন, বস্তুত, সর্বসম্মতিক্রমেই শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কেউ কেউ কিছু না জেনেই ভিত্তিহীন মতদ্বৈধতার প্রশ্ন তুলতে চান, কেউ আবার ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি আগেই চয়ন ও ব্যবহারের কীর্তি দাবি করেন- যার কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই। আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ৫০ বছর পূর্তি এবং শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের মনে রাখতে হবে এ দুটি ঘটনাই ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি এবং বাঙালি জাতির সম্মিলিত ইচ্ছার মহত্তম প্রকাশ।

সভাপতির বক্তব্যে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ৬৯-এ সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অগ্নি-আকাঙ্খায় উজ্জীবিত হয়েছিল। সংগ্রামী ছাত্রজনতার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির দাবি। উপনেবিশের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল আসাদ, মতিয়ুর, সাজর্ন্টে জহুরুল হক, শামসুজ্জোহা প্রমুখের রক্তে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে গতিবেগ দিয়েছে মিথ্যা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির দাবি। অবশেষে ছাত্রজনতার গণসংর্বধনায় ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদানের মাধ্যমে যেন আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হিসেবে যেন জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়। জাতির সে প্রত্যাশা তিনি পূরণ করেছেন। বাংলার বন্ধু হয়ে বাংলার মানুষের জন্য হাজার বছরের প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন মাকিদ হায়দার এবং ইকবাল আজিজ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাহমুদা আখতার। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা, খায়রুল আনাম শাকিল, ইয়াকুব আলী খান, লীনা তাপসী খান এবং ক্যামেলিয়া সিদ্দিকা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে আলাপনে অংশ নেন জাকির তালুকদার, নাসিমা আনিস, বিধান রিবেরু, তিথি আফরোজ এবং গিরিশ গৈরিক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সায়েরা হাবীব।

মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানসূচি: মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার পঞ্চম দিন। এদিন মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে কবি সিকান্দার আবু জাফর: জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন কবি নাসির আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান, ড. শিরীণ আখতার এবং কবি বায়তুল্লাহ কাদেরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

নিউজওয়ান২৪/আ.রাফি

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত