ঢাকা, ২৯ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ:

বাংলাদেশি বিজ্ঞানী দম্পতির আবিষ্কার: প্লাস্টিক থেকে ডিজেল

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০:২৫, ৯ অক্টোবর ২০১৮  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে শুরু করে অব্যবহৃত এক টন বর্জ্য থেকে ১৩০০ লিটার ডিজেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার অ্যাভিয়েশন বা জেট ফুয়েল উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী দম্পতি।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ড. মইনউদ্দিন সরকার ও ড. আনজুমান সেলী এ দাবি করেন।

সংবাদ সম্মেলনে এ দুই বিজ্ঞানী জানান, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের প্লান্ট স্থাপন করে বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে পরিবেশবান্ধব করতে চান তারা। তাদের তৈরি যন্ত্রগুলো দিয়ে এক টন প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য থেকে ১৩০০ লিটার ডিজেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে গেলে এক লিটার ডিজেলের মূল্য হবে মাত্র ২০ টাকা। 

ড. মইনউদ্দিন বলেন, ‘সারা দুনিয়ায় দিনে দিনে বাড়ছে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার, সেই সঙ্গে আমাদের চার পাশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। প্লাস্টিক পচনশীল নয় বিধায় মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা শক্তি। খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে, ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রোধ হচ্ছে। ফলে মশা-মাছির প্রকোপ বেড়েই যাচ্ছে, বৃষ্টি হলে শহরে নৌকা চালাতে হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্রাদুর্ভাবে বন ও জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে।’

‘শুধু আমেরিকাতেই প্রতি বছর ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক উৎপাদন হয়, যার মাত্র ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪.৮ বিলিয়ন পাউন্ড পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। আমাদের জানা মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়্যাস্ট (এমএস ডব্লিউ) বর্জ্য উৎপাদন হয়, যার মধ্যে ১৫ শতাংশই প্লাস্টিক অর্থাৎ ৪.২ মিলিয়ন প্লাস্টিক; যার মাত্র ১০ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ৬.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে, যার মাত্র ৯ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়েছে।’

ড. মইনউদ্দিন বলেন, ‘২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন বর্জ্য প্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে, যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০৫ সাল থেকে আমি ও আমার সহকর্মী ড. আনজুমান সেলী গবেষণা শুরু করি এবং ২০১০ সালে প্লাস্টিক থেকে তেল উৎপাদনের একটি প্রযুক্তি ও তার পেটেন্ট তৈরি করি। এটি নবায়নযোগ্য শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় দুই দশক গবেষণার পর আমরা সাফল্যের সাথে একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হই, যার মাধ্যমে প্রতি টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে ১৩০০ লিটার জ্বালানি তেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব।’

এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘নিজের গবেষণার সাফল্যেকে বাস্তব রূপ দিতে আমি নিজেই যুক্তরাষ্ট্রে প্লান্ট গড়ে তুলেছি। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলছি। উৎপাদন কোম্পানির নাম ওয়াস্ট টেকনোলজিস এলএলসি (আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র), কোম্পানিটি প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে তেল তৈরির কাজসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে। বর্তমানে কোম্পানিটি বাংলাদেশেও এ রকমের প্লান্ট করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই কেন্দ্র স্থাপন হলে একাধারে যেমন দেশকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি দেশের স্বল্প শিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত যুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। দেশ অর্জন করতে পারবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো সক্ষম যাবে। বাংলাদেশকে এশিয়ার বর্জ্য প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে দেশের আলাদা একটি জায়গা করতে সক্ষম হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে বিজ্ঞানী মইনউদ্দিন সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি প্লান্ট স্থাপন করতে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারাও এটিকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করে সার্বিক সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মাধ্যমে এ আবিষ্কারকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।’ তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা চান তিনি।

ব্যক্তিগত জীবন ও গবেষণার বিষয়ে মইনউদ্দিন সরকার জানান, তিনি ও আনজুমান আরা ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে বিজ্ঞানে এমএসসি পাস করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের ম্যানচেস্টার ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পিএইচডি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘হাই টেম্পারেচার সুপার কনডাক্টিং অক্সাইড’। তিনি গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যে (১৯৯১-১৯৯৬), তাইওয়ানে (১৯৯৬-১৯৯৯), বার্লিনে (১৯৯৯-২০০০) এবং ২০০১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইতোমধ্যে কাজ করেছেন কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসে। তাইওয়ানে তার গবেষণার সঙ্গী ছিলেন রসায়নে নোবেলজয়ী ড. ইউয়ান লি।

বিজ্ঞানী ড. মইনউদ্দীন সরকার বাদল ও আনজুমান আরাকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিনিউএবেল এনার্জি ইনোভেটর অব দ্য ইয়ারে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ ছাড়াও তারা একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেছেন।

ড. মইনউদ্দিন সরকারের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি। বাবা কামালউদ্দিন সরকার ছিলেন সরকারি কর্মচারী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে বড় মইনউদ্দিন। বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় কৃষি কাজও করেছেন তিনি। তার বর্তমান ইচ্ছা বিশাল সম্ভাবনাময় এই প্রযুক্তিকে বাংলাদেশে ব্যবহার করে পরিবেশ রক্ষা করা, বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা। মূলত এ কাজের জন্যই তিনি গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসেছেন।

নিউজওয়ান২৪

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত