ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

ইউনিফর্ম পরা পুলিশের কান্না দেখে নার্স বিব্রত!

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ১২ অক্টোবর ২০১৮  


বয়স আনুমানিক ৭৩ অথবা ৭৫! আমার বাবার বড় বোন তিনি, নাম পরীবানু। আমরা ডাকি পরী ফুপু বলে, তিনি চোখে দেখেন না বললেই চলে, কানেও কম শোনেন প্রায় শোনেন না বললেই চলে! কথা বলেন কিন্তু শুধু নিজের সাথে। কিছু বোঝেনও না। প্রায় একজন বিশেষ শিশুর মত। আমার দাদী গত হয়েছেন প্রায় ২২ বছর। তারপর থেকেই আমার বাবার এই বড় বোন আমাদের সাথে ছিলেন, আছেন! আমার বাবা গত হয়েছেন ০৯ বছর হতে চললো, মা নেই ০২ বছরেরও বেশি হতে চললো।

কেন লিখছি জানিনা, লিখতে ইচ্ছে হলো খুব...

আমার দাদী মারা যান প্রায় ২২ বছর আগে। দাদা দাদীর দ্বিতীয় সন্তান আমার এই পরী ফুপু; ছোটবেলায় দেখতে পরীর মত সুন্দর ছিলেন বিধায় দাদা দাদী নাম রাখেন পরীবানু। আমার দাদী যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তখন আমার প্রাণপ্রিয় মা ও আমার বড় বোন আমার দাদীর সাথে প্রায় ১ মাস হাসপাতালে থাকেন দাদীকে সেবাযত্ন করতে। একেবারে অন্তিম পর্যায়ে দাদী আমার মায়ের সামনে বারবার বলছিলেন, আমার পরীকে কে দেখবে? কে দেখবে? আমার মা তখন কিছুই বলেননি, কিন্তু দাদী মারা যাওয়ার পর এতগুলো বছর আমার সেই প্রাণপ্রিয় মা-ই আমার ফুপুকে দেখে রেখেছিলেন। কাজের লোক যা করেননি, আমার মা তাঁর স্বামীর বড় বোনের জন্য তার চেয়েও বেশি করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ! বাবা বেঁচে থাকাকালীন তাঁর নিজের এই বড় বোনকে নিজে গোসলও করিয়ে দিতেন মাঝে মাঝে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম এক দুঃখিনী বোনের প্রতি ছোট ভাইয়ের কি অমোঘ ভালবাসা!

বাবা-মা গত হওয়ার পর এখন দেখে রাখছেন আমার বড় ভাই ও মেজো বোন...

এতকিছুর অবতারণা কখনোই হতোনা, হচ্ছে কারণ আমার ফুপুটা অনেক অসুস্থ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সাথে আমার সবচেয়ে গভীর স্মৃতিময় সময় কেটেছে। আমার ফুপুর একটা ছেলেও ছিল। সন্তানের মারা যাওয়া ও অসুস্থতায় তিনি পুরোপুরি বোধহীন হয়ে যান। হয়ে পড়েন একজন শিশু! আমি যখন খুব ছোট তখন পরী ফুপুর কোলে কোলে থাকতাম, তাঁর পায়ে বসে দোল খেতাম এমনকি খাটে তার সাথে ঘুমাতাম। তাঁর হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কষ্ট অনেকটাই হয়তো লাঘব হতো আমাদের দিয়ে। আমি পাশে ঘুমালেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, পিঠ চুলকে দিতেন। ফুপু আমার এতটাই আপন ছিলেন যে অনেক বড় হয়েও ফুপুর পাশেই ঘুমাতাম। প্রচন্ড সৌখিন আমার এই ফুপু ছোট মাছ একদম পছন্দ করেন না, ছোট মাছ দিলে তাঁর ধারণা আমরা গরীব হয়ে গেছি! এমনকি বাসার দেয়ালে একটু ভাঙা পড়লেও তিনি ভাবতেন টাকা পয়সা নাই। সেই সময়ের ব্যবসায়ীর মেয়ে আচার আচরণে তাই সেই আভিজাত্যটুকু থেকেই যেত। একটু ময়লা হলেই হাত পা বারবার পরিস্কার করেন এখনো।

পরীফুপু আমাকে ডাকেন "ডুমু" বলে, কেন এই নামে ডাকা সেই রহস্য আজো ভেদ করা যায়নি। আমার ফুপুর গায়ে আমি আমার বাবার গন্ধ পাই। স্বামী, সন্তানহীন এক নারী জীবনের এতগুলো বছর নীরবে নিভৃতে নিজের সাথেই একা একা কথা বলে কাটিয়ে দিলেন কোন অভিযোগ ছাড়াই! কাজের ব্যস্ততায় আজকাল অত খবর নিতে পারিনা, আগে আমার গাল ছুঁয়েই বলে দিতেন ডুমু আইছে! এবার অফিস শেষে রাতে যখন তাঁর কাছে হাসপাতালে যাই বুকটা কষ্টে ফেঁটে গেলো। বাবাকে অসুস্থ দেখে যেভাবে হাউ মাউ করে কেঁদেছি, ঠিক একই কান্নার নোনা জলে আমার বুকটা ভেসে গেলো! ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের এরকম কান্না দেখে নার্স বিব্রত!

পরীফুপু আগের মত একা একা কথা বলেন না এখন, গাল ছুঁয়ে বললেনও না ডুমু আইছে! দুটি চোখের পাতা বারবার ভারী হয়ে যায়। এরকম ছোট্ট শিশুর মত একটা মানুষ কেন অসুস্থ হবে? আমার ফুপুকে দেখার জন্য ৩ জন মানুষ আছেন! ভাই,বোনেরা ব্যবস্থা করেছেন।

হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম হাত পায়ের নখ বিশাল বড় হয়ে গেছে, জিজ্ঞেস করতে বললেন কাউকে কাটাতে দেননা, কারণ ব্যথা পান। নার্সকে ও নাকি ধরতে দেননা, আমি ডুমু তাঁর হাত পা ভিজিয়ে নরম করে নখগুলো কেঁটে দিলাম। একটা টু্ঁ শব্দও করেননি আমার পরীফুপু, আমি যেমন তার মাঝে আমার মরহুম বাবাকে দেখতে পাই, তিনিও হয়তো আমার মাঝে নিজ সন্তানকেই পান...ব্যথা সম্ভবত এজন্যই লাগেনি

অনিয়ন্ত্রিতভাবে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল, তিনি কাউকে ধরতে দিলেন না, আমাকে ঠিকই দিলেন। আমার জীবনে আমার পরম আরাধ্য মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই। দাদা, দাদী,নানা,নানী কেউ নেই! এত নাইয়ের মাঝে আমার ছোটবেলার পরম কাছের এই মানুষটি আছেন কিন্তু এখন তিনিও অনেক অসুস্থ।

প্রতিটা মুহূর্তে শুধু একটি বিষয়ই মাথায় আসছে জীবন এই মানুষটিকে কী দিল? কী পেলেন তিনি? স্বামী,সন্তান,বাবা,মা সবাইকে হারিয়ে ভাই, ভাইয়ের বউকে হারিয়েছেন! দুঃখ বাটবেন? সেটাই বা কিভাবে সম্ভব? কথাইতো বলতে পারেন না! খাবার ছাড়া কোনো কিছু নিয়ে একটু অভিমানও করতে পারেন না! এ তবে কেমন জীবন! জীবন কি একটুও খুশি হয়ে ধরা দিতে পারলোনা আমার এই নিষ্পাপ ফুপুর প্রতি!? 

সর্বশক্তিমান আল্লাহ যেন তার মত নিষ্পাপ শিশুর সকল কষ্ট লাঘব করে দেন!

আমি সন্তানসম ডুমু এতটুকু তো চাইতেই পারি...

লেখক ইফতিখায়রুল ইসলাম, সিনিয়র এএসপি ডেমরা জোন

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া)

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত