ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

আসলে কে এই জজ মিয়া?

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ৯ অক্টোবর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

বহু প্রতীক্ষিত নৃশংস ২১ গ্রেনেড হামলার ঐতিহাসিক রায় বুধবার। দেশের ইতিহাসে বিভীষিকার অন্যতম সে দিনটির কথা দেশের মানুষ আজীবন মনে রাখবে আর ভেবে বার বার শিউরে উঠবে। এ মামলায় হতাহত হয়েছেন অনেকেই। তবে এই গ্রেনেড হামলার কথা উঠলেই হতাহত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি আরেকটি নাম ঘুরে ফিরে আসে। তিনি জজ মিয়া।

ঢাকায় ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আড়াইশ’র বেশি লোক, যারা এখনো গ্রেনেড হামলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। এ হামলার পর বিচারের প্রহসনের নামে লজ্জাজনক এক নাটক সাজায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। তারই প্রেক্ষিতে ইতিহাসের পাতায় এটি ‘জজ মিয়া নাটক’ নামে জায়গা করে নেয়। গ্রেনেড হামলার সত্যিকারের অপরাধীকে আড়াল করার জন্য নিরপরাধ সিডি বিক্রেতা জজ মিয়াকে আটক করে হামলার মূল হোতা বানানোর চেষ্টা করে বিএনপি সরকার।

মামলাটির অন্যতম একজন আসামি ছিলেন এই জজ মিয়া। মামলায় তাকে হামলায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু, এত বড় আর চৌকশ ঘটনাটি নোয়াখালির একজন সাধারণ মানুষ কী করে ঘটালেন তা নিয়ে প্রশ্ন আজও শেষ হয়নি। ঘটনার কোনো সূত্র না মেলায় গোয়েন্দা সংস্থার সাজানো এই চিত্রনাট্যটি গণমাধ্যমসহ সব মহলে তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সেটা যে নেহাতই ষড়যন্ত্র, তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। নির্যাতন চালিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। খবরে শিরোনামে উঠে আসে জজ মিয়ার নাম। তবে তার জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল। এ হামলার অন্যতম শিকার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলীয় রাজনৈতিক নেতারাও মোটামুটি ঘোষণাই করেন যে জজ মিয়া স্রেফ ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন।

বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলের ওই হামলায় জড়িতদের রক্ষায় নানা অপতৎপরতার অভিযোগ ছিল এ মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডির বিরুদ্ধে। এরই একজন জজ মিয়া। তাকে নিয়ে সাজানো হয় অসম্ভব একটি গল্প। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে এ কাজে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। গ্রেনেড হামলার ঘটনাস্থল বা পরিকল্পনার সঙ্গে না থেকেও ক্ষতির শিকার হন জজ মিয়া।

গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতে ২০০৫ সালের ১০ জুন নোয়াখালীর সেনবাগের বাড়ি থেকে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকা জজ মিয়াকে প্রথমে সেনবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাকে ঢাকায় এনে নির্যাতন চালায়।

১৭ দিন রিমান্ডের পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হামলার জন্য দায়ী করে রাজধানীর ১১ সন্ত্রাসীর নাম উল্লেখ করেন জজ মিয়া। এরা হলো- রবিন, শফিক, বকুল, হাশেম, লিংকন, আনু, মুকুল, সুব্রত বাইন, জাহিদ, জয় ও মোল্লা মাসুদ। জজ মিয়া বলেন, হামলায় নেতৃত্ব দেয় বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল। তবে এ জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। জজ মিয়া এও বলেছিলেন, গ্রেনেড ও বোমার পার্থক্যও তিনি জানেন না।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় যখন জজ মিয়াকে ফাঁসানো হয় তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। নোয়াখালীর সেনবাগে ভিটেমাটি থাকলেও গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে পোস্টার ও ক্যাসেট বিক্রি করে কোনোমতে জীবিকা চলত।

তাকে মুক্ত করতে ছয় বছরের আইনি লড়াইয়ে সেই ভিটেমাটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল জজ মিয়ার পরিবার। তাকে মুক্ত করতে তার ভাই, বোন সবাই নিঃস্ব হয়ে গেছে। কারাগার থেকে মুক্তি মিললেও অতি কষ্টে দিন যায় তার।

সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। কিন্তু ততদিনে জীবন থেকে চলে গেছে মূল্যবান পাঁচটি বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুনর্বাসনসহ চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর পর গেছে আরো আট বছর। এখন তার বয়স ৩৭ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুত চাকরির দেখা পাননি জজ মিয়া। ধারের টাকা ফেরত দিতে মুক্তির বছরেই সাড়ে ৭ শতাংশ পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে এলাকা ছাড়েন জজ মিয়া।

এ বছরের শুরুতে জজ মিয়ার মা মারা গেছেন। দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। টাকা ধার নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। সেই টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি। জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোরও চেষ্টা করেছিলেন জজ মিয়া। প্রাইভেট গাড়ি চালানো শুরু করেছিলেন তিনি। আড়াই বছর আগে বিয়েও করেন। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনে ভেঙে যাওয়া হাড়গুলো জোড়া লাগলেও এখনো যন্ত্রণা দেয় তাকে। ওষুধে ব্যথা কিছুটা উপশম হলেও ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।

নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বোকারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের মৃত আবদুর রশিদের ছেলে জজ মিয়া। জন্ম ঢাকার তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়। বাবার ভাঙারি ব্যবসার সুবাদে পরিবারের সঙ্গে প্রথমে তিব্বত বস্তি পরে নাখালপাড়া নূরানী মসজিদের পাশে থাকতেন। বাবার মৃত্যুর পর পঞ্চম শ্রেণি পাস জজ মিয়ার পড়াশোনা আর হয়নি। কিছুদিন বড় ভাই আলমগীরসহ বাবার ভাঙারি ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন। পরে রাজধানীর গুলিস্তানে হকারের কাজ করতেন।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন তদন্তের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন নতুন অভিযোগ পত্রে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালের ২২ জুন বাড়তি তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সে বছরই ৩ আগস্ট সিআইডির নতুন কর্মকর্তাদের যুক্ত করে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় জজ মিয়াকে, মুক্তি পান তিনি। কিন্তু বিনা অপরাধে সেই বিভীষিকার সময়টি তিনি কখনোই ভুলবেন না, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নিউজওয়ান২৪

আরও পড়ুন
আইন আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত