ঢাকা, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

‘দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান’- তৃতীয় পর্ব

তাহির মেহদি, পাকিস্তান

প্রকাশিত: ১৭:১৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ১৩:১৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

[বাংলাদেশ সম্পর্কে গড়পড়তা পাকিস্তানিরা কী ভাবে? আমাদেরকে তারা কোন নজরে দেখে বা মূল্যায়ন করে? এর সহজ উত্তর— দু’একটি ব্যতিক্রম এবং বুদ্ধিজীবী মহলে ৭১’র ঘটনাবলী নিয়ে সত্যভাষণের কিছু চেষ্টা ছাড়া বাংলাদেশি তথা বাঙালিদের ব্যাপারে তারা নেতিবাচক ধারণায় তাড়িত। পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন.কম এর ভাষায়— “পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের চোখের দিকে তাকাতে রাজি নয়। তারা ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর খুবই খেলো ধরনের এক গল্প-গাথার আড়ালে নিজেদের লুকোতে চায়, যে গল্পে সেই ঘটনাকে স্রেফ ষড়যন্ত্র হিসেবেই বোঝানো হয়েছে। খুব ভাল হতো যদি একত্রে থাকা যেত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে ষড়যন্ত্র করেছিল কার বিরুদ্ধে? বাঙালিদের করার-ই বা কী ছিল তখন? কীভাবে তারা বিচ্ছিন্নতার মোড়ে পৌঁছালো?” এই কথাগুলো ডন বলেছে সাম্প্রতিককালে তাদের প্রকাশিত ‘দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান’ শিরোনামের একটি লেখায়। তাহির মেহদি রচিত ৪ পর্বের ওই লেখায় বাংলাদেশ তথা বাঙালিকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। দু’একটি বিচ্যুতি ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে গড়পড়তা পাকিস্তানি মূল্যায়নের ব্যতিক্রম এ লেখাটি। আমাদের এখানে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক মহলটি ’৭১-এ তাদের ভূমিকায় দোষ স্বীকার করতে না চাইলেও এ লেখায় একজন পাকিস্তানি হিসেবে লেখক ’৭১ ও এর আগের সব নেতিবাচক ঘটনাবলীর জন্য প্রকারান্তরে প্রায় সব দায়ই পশ্চিম পাকিস্তানিদের বলে মেনে নিয়েছেন। লেখকের অনুমতিতে আগ্রহোদ্দীপক এ লেখাটির বাংলায় ভাষান্তর করেছেন আহ্‌সান কবীর। নিউজওয়ান২৪.কম পাঠকদের জন্য গত ১১ ডিসেম্বর এর প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হয়। এবার রয়েছে লেখাটির তৃতীয় পর্ব]

আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন ‘দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান’- প্রথম পর্ব

                                       ‘দ্য ক্রো ইজ হোয়াইট, বেঙ্গল ইজ পাকিস্তান’- দ্বিতীয় পর্ব

বাঙালি, ভারতীয়, মুসলিম, গরীব, কৃষক

প্রত্যেক ব্যক্তিসত্তার একাধিক পরিচয় থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এই একের অধিক পরিচয়গুলোকে নিয়ে আমরা একটির পরিপূরক হিসেবে অন্যটিকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অথবা একটির সঙ্গে অপরটির দ্বন্দ্ব-বিধূর পরিবেশে থাকতে পারি। এসব আলাদা আলাদা সত্তার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াটা জটিলই। আর এগুলো যে রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি করে তা জটিলতর, ষড়যন্ত্রমুখর আর প্যাঁচালো। অন্য কথায় বলতে গেলে— আমাদের কারো পরিচয় হতে পারে বাঙালি মুসলিম বা পাঞ্জাবি মুসলিম অথবা মুসলিম কৃষক কিংবা হিন্দু কৃষক বা পাঞ্জাবি কৃষক না হয় বাঙালি কৃষক। এ ধরনের পরিচয়ধারী গ্রুপগুলোর প্রতিটির রাজনৈতিক আকাঙ্খা আর গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে ঐক্য গড়ে তোলে আবার অন্য কোনো বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। আর রাজনৈতিক দল বা নেতার সাফল্য নির্ভর করে এ ধরনের বহুমুখী রাজনৈতিক স্বার্থ আর উদ্দেশ্যগুলোর সম্মিলন ঘটিয়ে সবাইকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে যূথবদ্ধ করার মধ্যে।

আর এই ক্ষণে ঐক্য আর ক্ষণে অনৈক্যর ধারাবাহিকতা চাক্ষুষ করতে চাইলে আপনাকে আমাদের ইতিহাসের পাতায় ঢুঁ মারতে হবে— আপনাদেরকে পরিচিত হতে হবে জনাব আবু কাসিম ফজলুল হকের (আবুল কাশেম ফজলুল হক) সঙ্গে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ কায়েদ-এ-আযম যখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের (এআইএমএল) সাধারণ সভায় তাকে পাকিস্তান প্রস্তাব উপস্থাপনকারী হিসেবে বেছে নিলেন, তখন তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী।

মুসলিম লীগের এই সভায় অংশগ্রহণের জন্য পাঞ্জাব, সিন্ধু, পাখতুনওয়া, বালুচিস্তানসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে লাহোরে জড়ো হওয়া মুসলিম নেতারা সবাই ওই প্রস্তাব সমর্থন করেন যা মুসলিম লীগকে ভারত জুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই নেতাদের খুব কম সংখ্যকই ১৯৩৬ এর নির্বাচনে এআইএমএল-এর টিকেটে বিজয়ী হয়েছিলেন কিন্তু মুসলিম লীগের জনপ্রিয় কর্মসূচির প্রবক্তা হলেন তারাই।

শের-এ-বাংলা নামে সমধিক পরিচিত ফজলুল হক ওই সময়টায় অবিভক্ত বাংলার কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন। তার কৃষক প্রজা পার্টি (আক্ষরিক অর্থে কৃষকদের দল) ১৯৩৬ এর নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ওই নির্বাচনে প্রথম স্থান অধিকার করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস আর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মুসলিম লীগ। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ-ই পায়নি। এ অবস্থায় একমাত্র কোয়ালিশন সরকারই ছিল নিয়তি। হক মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পছন্দ করেননি এবং নির্বাচনে মুসলিম নবাব আর জায়গিরদারদের এই দলটির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।

হক চেয়েছিলেন বাঙালি পরিচয়টাকে নির্মাণ করতে এবং ভেবেছিলেন তারই মতো সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নীতির ধারক কংগ্রেস তার সঙ্গী হবে। কিন্তু সম্ভবত কংগ্রেস তার কৃষক-কেন্দ্রিক রাজনীতিকে নিজেদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় লোহিত বর্ণের (কমিউনিস্ট) হিসেবে বিচার করে (But Congress probably found Haq’s farmer-centered politics too ‘red’ to accommodate). এছাড়া প্রজা পার্টির কিছু নেতাকে কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ করা হতো। বাঙালি কৃষকরা জমিদার এবং দাদনদার-মহাজন যাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু, তাদেরকে নিজেদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করতো আর এর বিপরীতে অভিজাত শ্রেণির ওই হিন্দু রইসদের মাঝে কংগ্রেস খুঁজে পায় তার একনিষ্ঠ অনেক সমর্থককে। সর্বোপরি কংগ্রেসের নীতি ছিল বাঙালি বা পাঞ্জাবি হওয়ার চেয়ে ভারতীয় হওয়ার পক্ষেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া।

আর তাই কংগ্রেস ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাকে মুসলিম লীগের দিকে ঠেলে দিল যে সুযোগ লুফে নেওয়ার জন্য মুসলিম লীগ হাত বাড়িয়েই ছিল। এর ফলে (মুসলিম লীগ-কৃষ প্রজা পার্টি) কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হলো। তবে এর এক সপ্তাহের মধ্যেই কৃষক প্রজা পার্টির একটি গ্রুপ দলের বাজেটারি কর্মসূচির বিরোধীতায় স্বপক্ষ ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দিল।

অপরদিকে, প্রজাদলের অধিক ‘লালপন্থি’ সদস্যরা ভাবনায় পড়লেন যে তাদের দল নির্বাচনী ইশতেহারের নীতিচ্যুত হচ্ছে। বহুধাবিভক্ত মতভেদের ফলে দলের ভেতর দলাদলির সৃষ্টি হল, ফলে কৃষক প্রজা পার্টি দুর্বল হয়ে পড়লো এবং কোয়ালিশন প্রধান হিসেবে হকের অবস্থানও নড়বড়ে করে দিল। এর ফল হলো বাংলার রাজনীতিকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্তকরণে দৃড়প্রতিজ্ঞ ফজলুল হক ক্রমশ মুসলিম লীগের ওপর উল্টো আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন।

পাকিস্তান প্রস্তাবের কিছুকাল পরে, হক দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধীতায় নামলেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই প্রচারণা শুরু করলেন। তবে ফজলুল হকের এ পদক্ষেপ কোনোমতেই এটা বোঝায় না যে ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে নিজেদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুসলমানদের আবেগের প্রতি তিনি একাত্ম ছিলেন না। বয়সে কায়েদ-এ-আযমের চেয়ে ৩ বছরের বড় ফজলুল হক ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক বাংলা মুসলিম লীগের সম্পাদক এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এছাড়া ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের যুগ্ন সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন (তখন পর্যন্ত একইসঙ্গে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের সদস্য হওয়াটা অধর্ম বলে বিবেচিত হয়নি)।

কিন্তু ওই সময়ের অধিকাংশ মুসলিম নেতার মতোই, তিনিও বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পটভূমিতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র পরিচিতির বিষয়টিকে বিচার করতেন। তবে অনেক মুসলিম নেতাই বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় তাদের লক্ষ্যকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যান— তা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা দেশ। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হন হক।

মুসলিম লীগ ‘মুসলমানদের নিজের দেশ’ ধারণাকে তাদের সব রোগের ঔষধ হিসেবে উপস্থাপনে সফল হল— আইডিয়াটি জনসমর্থনও পেল। অপরদিকে, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে হকের প্রজা পার্টি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়লো— তারা পেল মাত্র ৪টি আসন যার দু’টি ছিল হকের নিজের। এর বিপরীতে মুসলিম লীগের স্বপ্ন পূরণ হলো— বাংলায় সংরক্ষিত ১১৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে তারা পেল ১১০টি।

মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি সরকার গঠন করলেন বাংলায়। ১৯৪৬ সালের আগস্টে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধলো। সাম্প্রদায়িক ওই দাঙ্গার রক্তস্রোত যেসব জায়গায় বইলো তার সবখানেই হিন্দু-মুসলিম সীমানার সূচনা করলো। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে হক মুসলিম লীগে যোগ দিলেন এবং দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে এলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেন।

হক তার পছন্দের রাজনৈতিক আকাঙ্খাগুলোকে যূঁথবদ্ধ করতে ব্যর্থ হলেন এবং এর ফলে অন্যসব নেতাদের কূট-কৌশলের জোয়ারে তলিয়ে গেলেন। মুসলিম লীগ তার পছন্দের ধর্মীয় ধারায় চলমান রাজনৈতিক সংলাপকে নিজের মুঠিতে নিয়ে নিল এবং তার মূল উদ্দেশ্য হাসিলে সক্ষম হল। তবে এই দলটি তাদের প্রতি বাঙালিদের সমর্থণকে ভুল মূল্যায়ন করলো।

প্রকৃতপক্ষে বাঙালিরা এটা ভাবে নাই যে মুসলমান হতে গেলে তাদেরকে বাঙালিয়ানা ছাড়তে হবে অথবা পাকিস্তানি হতে গেলে তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দুয়ানি ত্যাগ করতে হবে।*

স্বাধীনতার কয়েক মাস পরেই, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা আন্দোলনে নামলো এবং দাবি জানালো তাদের মাতৃভাষাকেও একই মর্যাদা দিতে হবে। হক এ আন্দোলনে যোগ দিলেন এবং পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হলেন।

অপরদিকে, আইনসভার অধিবেশন পৌনঃপুনিক অচলাবস্থায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। বাঙালিরা বলছিল না যে, অন্য সবাই তাদের কাছে নত হোক। তারা শুধুমাত্র তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো দাবি করছিল— তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সম্মান দিতে হবে, তাদের সম্পদ তাদের অধিকারেই থাকবে, জনসংখ্যানুপাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে ন্যায্য পাওনা তাদের দিতে হবে।

কিন্তু ‘নীল-রক্তের মুসলিম লীগ নেতৃত্ব’ ভেবেছিল, ধর্মের তুরুপ-তাস দিয়ে তারা সবগুলো বাজী জিতে যাবে। আর সে মতে, যদি কেউ মাতৃভূমির অধিকার আদায়ের দাবি তোলে, তাকে চটকদার বিশ্ব-মুসলিম ভ্রাতৃত্বের আদর্শ বিরোধী সংকীর্ণ প্রাদেশিকতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদি কেউ তার দেশের সম্পদে নিজ অধিকার দাবি করার সাহস দেখায় তাকে অভিযুক্ত করা হয় ইসলামি জাগরণ প্রতিরোধকারী হিসেবে আর যদি কেউ তার মাতৃভাষার মর্যাদা দাবি করে তবে নিশ্চিতভাবে সে চিহ্নিত হযে যায় একজন বিশ্বাসঘাতক আর ভারতীয় দালাল হিসেবে।
বাংলা কোনো করদ রাজ্য (banana state) ছিল না আর মুসলিম লীগও কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিল না। এ পরিস্থিতিতে বাঙালিরা মনস্থির করলো, এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে।

পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীর গদিনশীনরা সম্ভবত বাংলায় কী ঘটছে তা ভালই জানতেন। ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত পাঞ্জাব, সিন্ধু, পাখতুনওয়া এবং বাংলার আইন পরিষদের মেয়াদ ১৯৫১ সালে শেষ হওয়ার পথে ছিল। এ সময়ের মধ্যে দেশের আইন পরিষদ নয়া রাষ্ট্রটির জন্য বৃহত্তর আঙ্গিকের একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়। আর নয়া পদক্ষেপের অনুপস্থিতিতে পুরনো আইন পরিষদকেই কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।

১৯৫১ সালের মার্চে পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির নির্বাচন হয় আর পাখতুনওয়ায় (তকালীন এনডব্লিউএফপি) নির্বাচন হয় একই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে। ১৯৫৩ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে, ১৯৫১ সালে সিন্ধুতে গভর্নরের শাসন চালু করা হয়। আর সবগুলো নির্বাচনেই মুসলিমল লীগ জিততে সক্ষম হয়। এই দলটি ১৯৪৬ সাল থেকে পূর্ব বাংলায়ও ক্ষমতাসীন ছিল।

এ পটভূমিতে দেশের রাজনৈতিক আবহ সবকিছু পরিষ্কার বলে দিচ্ছিল, আর মুসলিম লীগ তাদের স্বার্থে যা করতে পারতো তা হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনকে যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করা।

যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করা হলো পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের নির্বাচন হবে ১৯৫৪ সালের মার্চে।

এরমধ্যে ১৯৪৯ সালের শুরুতেই পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ নেতাদের বৃহৎ একটি অংশ দল ত্যাগ করেছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অপরাপর নেতারা গঠন করেছেন অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ফজলুল হকও ১৯৫৩ সালে গঠন করেছেন নয়া দল শ্রমিক কৃষক পার্টি। এ দু’টি দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে ৫৪’র নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং ফজলুল হককে জোটের নেতা হিসেবে বেছে নিল।

যুক্তফ্রন্ট হিসেবে পরিচিত এই জোট ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলো। দফাগুলোর মধ্যে ছিল— বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, জনসংখ্যার ভিত্তিতে পার্লামেন্টে বাঙালিদের জন্য আসন বরাদ্দের বিরোধীতাকারী খসরা সংবিধান প্রত্যাখ্যান, দেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার স্বার্থে পুরনো অ্যাসেম্বলি বাতিল করে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নয়া অ্যাসেম্বলি গঠন প্রভৃতি।

মুসলিম লীগ সংকট উত্তরণে পাগলের মতো কোনো কিছু একটা ধন্বন্তরির সন্ধানে ছিল। নির্বাচনী প্রচারণায় অনুকূল আবহ আনতে তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বোন ফাতেমা জিন্নাহকে পূর্ব বাংলায় এক ঝটিকা সফরে পাঠালো। কিন্তু ইতোমধ্যে বাঙালিদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। তাই ফাতেমা জিন্নাহ মুসলি লীগের প্রত্যাশা মতো সেখানে কোনো যাদু-ই দেখাতে পারলেন না। ৩০৯ সদস্যের পার্লামেন্টে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেল নগন্য ১০টি আসন মাত্র। অন্যদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেলেন ৩টি, খিলাফত-ই-রব্বানি ১টি আর যুক্তফ্রন্ট পেল ২২৩ আসন! এরচেয়ে বড় গণরায় আর কিছু হতে পারে না।

কিন্তু জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পরিষদকে পুরনো আইন পরিষদের স্থলাভিষিক্ত করতে যুক্তফ্রন্টের দাবি অগ্রাহ্য করে রাজধানী করাচীর কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালিদের কাছে কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয় তেমন একটি সংবিধান রচনা ও অনুমোদনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

পাকিস্তানের তথাকথিত সরকার (establishment) জানতো— বাঙালিদের টলানো যাবে না। আর তাই তারা নানা বাহানায় পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান ঝুলিয়ে রাখলো দীর্ঘ ১৬টি বছর। আর ১৯৭০ সালে সেই নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হলো, তাতে দেখা গেল, ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য বরাদ্দ ১৬২ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬০টি আসন। এবারও গণরায় ছিল উচ্চকিত আর পরিষ্কার। কিন্তু তথাপি বাঙালিরা ফের দেখলো কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী করাচীর গদীনশীনরা কেউ তাদের আওয়াজ শুনছে না।

এবার তারা অবশ্যই বুঝতে পারলো— ঘুমন্ত কাউকে ডেকে তোলা যায়, কিন্তু ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে এমন কাউকে জাগিয়ে তোলা অসম্ভব।

*লেখকের এই মতটি (or being Pakistani compelled them to quit being Hindu) কিছুটা বিভ্রান্তিকর এবং বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এতে মনে হচ্ছে তিনি ধারণা করছেন, পূর্ব বাংলা বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সবাই একই সঙ্গে হিন্দু এবং মুসলমান

[তাহির মেহেদি: পাঞ্জাব লোক সুযোগ নামে একটি গবেষণা ও প্রচার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানটি গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে]

মোট ৪ পর্বের লেখাটির প্রথম পর্বটি প্রকাশ হয় পাকিস্তানের অভিজাত ও প্রভাবশালী মিডিয়া দ্য ডন-এ ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর (এরপর ধারাবাহিকভাবে বাকি পর্বগুলো প্রকাশ করা হয়)। তখনি লেখকের অনুমতি নিয়ে এর বাংলায় ভাষান্তর করি যা প্রথম প্রকাশ হয় ১৫ ডিসেম্বর, ২০১২ একটি অনলাইন পোর্টালে। এদিকে, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ দেখা গেল ডন.কম লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং আরও বিশাল পাঠককে এটা পড়ার সুযোগ করে দিতে নিউজওয়ান২৪.কম-এ লেখাটি ফের প্রকাশ করা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে: আহ্‌সান কবীর, অনুবাদক

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

একই ধরনের আরও লেখার জন্য ক্লিক করুন যে ‘তুচ্ছ খড়-কুটো’র বোঝা পাকিস্তান নামক ‘উটের’ মেরুদণ্ড ভেঙে দেয় 

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত