ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

আজ সেই দিন যেদিন মাস্টারদা…

সাবাশ বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ১৮ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ১৩:৪৮, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বের বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করে। কিভাবে দানা বেঁধেছিল সেই ঘটনার পটভূমি?

সূর্য সেন ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা পূর্ববঙ্গে জন্মানো এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজ জীবন উৎসর্গ করেন।

তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়। এছাড়া কলকাতা মেট্রো সূর্য সেনের স্মরণে বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনটির নামকরণ করেছে ‘মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন’ নামে।

সূর্যসেন ওরফে মাস্টারদা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী, বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক ছিলেন।

মাস্টারদার জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। ডাক নাম কালু। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী।

স্থানীয় দয়াময়ী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন এবং ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন।

সূর্যসেন যখন নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) কেন্দ্র করে বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমে এই আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯১৬ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃঞ্চনাথ কলেজে বিএ পড়ার সময় তিনি তাঁর এক শিক্ষক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর বৈপ্লবিক আদর্শে দীক্ষিত হন। অধ্যাপক শতীশচন্দ্র যুগান্তর নামের বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সূর্যসেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে ফিরে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী যুগান্তর দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। পরিচয় গোপনের কৌশল হিসেবে তিনি ‘ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি পরিচিত মহলে ‘মাস্টারদা’ আখ্যা পান।

এদেশে বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন ও যুগান্তর- এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। বহরমপুর থেকে ফিরে এসে সূর্যসেন যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে সংগঠনটিকে সক্রিয় করে তোলেন এবং বিবাদমান দল দুইটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে অবিভক্ত ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামের ছাত্ররাও ক্লাসবর্জন সহ সভা-সমাবেশ করে। সভায় সূর্যসেন তাঁর বক্তৃতায় ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন।

এ সময়ের দুটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। (১) ব্রিটিশ মালিকানাধীন জাহাজের শ্রমিকদের সফল ধর্মঘট এবং (২) ব্রিটিশ মালিকানাধীন সিলেট ও কাছাড়ের চা বাগান শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং চাঁদপুরে ধর্মঘটি শ্রমিকদের ওপর পুলিশ ও গোর্খা সৈন্যদের গুলিবর্ষণে অনেকের হতাহত হওয়ার ঘটনা।

এর প্রতিবাদে আসাম-বেঙ্গল রেল ধর্মঘট শুরু হয়। এর ফলে চট্টগ্রামের কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও শেখ-ই-চাটগ্রাম কাজেম আলী মাস্টারের পাশাপাশি মাস্টারদা সূর্যসেনের নামও ছড়িয়ে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তিনি স্কুলের শিক্ষকতা ত্যাগ করেন এবং দেওয়ানবাজার এলাকায় ‘সাম্যশ্রম’ নামের আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে গোপনে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে গান্ধির স্বরাজ অর্জিত না হলেও বাংলার বিপ্লবীরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে সংকল্পবদ্ধ হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মাস্টারদার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। বিপ্লব পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটাতে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের চট্টগ্রাম কোষাগার লুণ্ঠন করা হয়। এই ঘটনার কিছুদিন পরই সূর্যসেন ও আম্বিকা চক্রবর্তীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। সূর্যসেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের জন্য ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করে শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য কসরতের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি নদীতে সাঁতার কাটা, নৌকা বা সাম্পান চালানো, গাছে আরোহণ করা, লাঠি খেলা, ছোরা নিক্ষেপ, মুষ্টিযুদ্ধের মতো শারীরিক কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি বিপ্লবীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। চট্টগ্রামে তিনি ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র একটি শাখা গড়ে তোলেন।

১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এতে সূর্যসেন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। একই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে একটানা ৬৩ দিন অনশন করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মারা যান। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা বাংলায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভ মিছিল ও সভায় নেতা সূর্যসেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। বিপ্লবীরা স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। এর জন্য তাঁরা ‘মৃত্যুর কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন।

প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশদের ওপর হামলার দিন নির্ধারণ করা হয় ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পুলিশী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এর তারিখ পিছিয়ে যায়। এ সময়েই গঠিত হয় সূর্যসেনের গোয়েন্দা দল। গোয়েন্দা দলের বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তাঁদের প্রস্তুতি চলে। সূর্যসেন গোপনে ইস্তেহার প্রচার করেন। এতে তিনি কৌশল হিসেবে প্রচার করেন যে, ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের গান্ধি ময়দানে বিপ্লবীরা নিষিদ্ধ পুস্তক পাঠ করে আইন অমান্য করবেন। এতে সূর্যসেনসহ আরও কয়েকজন বিপ্লবীর নাম ছাপা হয়। কর্মসূচির প্রকৃত তারিখ ছিল ১৮ এপ্রিল।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফসল।

প্রাথমিক পর্যায়ে অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে বিপ্লবের সূচনা হলেও সময়ের ব্যবধানে সংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে হিংসাত্মক কর্মনীতি বা বিপ্লববাদ দেখা দেয়। ওই সময় ব্রিটিশ শাসক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আসন্ন গুড ফ্রাইডেতে বিপ্লবী ব্রিটিশ স্বার্থে হামলার পরিকল্পনা করেন। এ উপলক্ষ্যে বিপ্লবীদের ঘোষণাপত্রের প্রথমটিতে ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়টিতে ছিল দেশের যুবকদের প্রতি রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদানের আহবান।

ওদিকে, ১৮ তারিখে গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ইউরোপীয়ান ক্লাবে ইংরেজ পদস্থ কর্মকর্তারা কেউ উপস্থিত ছিল না এবং অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগারে ভারী অস্ত্র মিললেও কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। ফলে এই দুটি ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা আসেনি। তবে সূর্যসেনের নেতৃত্বে পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের পর অস্ত্র ও গুলি সংগৃহীত হয়।

অস্ত্রাগারে আগুন লাগানোর সময় অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন বিপ্লবী হিমাংশু বিমল সেন। সূর্যসেন পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। তিনি দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, বিপ্লবী দল চট্টগ্রামে গিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ করবে। সবাই এতে একমত হলে মাস্টারদা লোকনাথ বলকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রী বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন ও বিপ্লব পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল এ সংঘটিত যুদ্ধে ১৪ জন বিপ্লবী শহীদ হন। সূর্যসেনের নেতৃত্বে অন্যরা পাশের পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। তাদের ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে।

সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইবুনালে শুরু হয়। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টারদা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে বোমা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম কারাগার ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় ১১ জন বিপ্লবী গ্রেফতার হন।

তবে ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এ অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের ‍মুখে সঙ্গী বিপ্লবীদের তথ্য প্রকাশ করার ঝুঁকি এড়াতে তিনি সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

এ ঘটনার পরে মাস্টারদা পটিয়ার কাছাকাছি গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতক গ্রামবাসী সূর্যসেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেয়। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে একদল গুর্খা সৈন্য বিপ্লবীদের আত্মগোপনের স্থানটি ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে সৈন্যবেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সূর্যসেন ধরা পড়েন। সঙ্গে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, সুশীল দাস গুপ্ত ও মনিলাল দত্তসহ আরও কয়েকজন বিপ্লবী।

অপরদিকে, ‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার নতুন সভাপতি তারকেশ্বর দস্তিদার সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম জেল থেকে ছিনিয়ে আনার প্রস্ততি নেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। সঙ্গীদেরসহ তারকেশ্বর গ্রেফতার হন। ১৯৩৩ সালে বিশেষ আদালতে বিচার হয় সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের। ১৪ আগস্ট সূর্যসেন ও তারেকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে বিপ্লবী সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করে ব্রিটিশ সরকার। সূত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া

নিউজওয়ান২৪.কম/ডিআই

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত