ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

আমাদের পূর্বপুরুষ...

সাতরং ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ১৯ মার্চ ২০১৯  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

হোমো-ইরেক্টাস সবাই এ শব্দটি জানেন। এরা আমাদের পূর্ব-পুরুষ (পূর্ব নারীও বটেই)।

তা আজ যদি আচমকা আপনার সঙ্গে গলির মোড়ে দেখা হয়ে যায়, চিনতে পারবেন কী? না পরিচিত ঘনিষ্ঠজন হিসাবে তো আপনার পারিবারিক পূর্বপুরুষদেরও, ধরুন চৌদ্দ পুরুষ আগের কেউ হলে চিনতে পারবেন না। কারণ চেহারাটাই অন্যরকম মনে হবে। তবুও ওনাকে একজন মানুষ হিসাবে অবশ্যই চিনতে পারবেন। কপাল ভালো থাকলে বঙ্গ সন্তান বলেও বুঝতে পারবেন। কপালের কথা আসছে, কারণ, তিনি যে বঙ্গ সন্তানই হবেন এমন গ্যারান্টি দেয়া কঠিন।
 
কিন্তু হোমো-ইরেক্টাস? তারা কী সত্যিই আমাদের পূর্ব-পুরুষ। খুব গোলমেলে ব্যাপার। হ্যাঁ বললেও বলতে পারেন। না বললে তর্ক হবে বটে তবে কে জিতবে বলা কঠিন। সেই যাই হোক তেমন কাউকে যদি দেখতে পান, চিনতে পারবেন কী? কতটা চিনতে পারবেন? মানুষ হিসাবে চিনতে পারবেন? সম্ভবত পারবেন। মানুষ হিসাবে চিনতে পারাটা খুব অসম্ভব হবে না। কারণ তার শারীরিক গঠন, তার আকার, আকৃতি-প্রকৃতি, চাল-চলন, খুব চেনা মনে হবে।

আসলেই শারীরিক গঠনের দিক থেকে হোমো-ইরেক্টাস আর এই আমরা হোমো-স্যাপিয়েনসরা খুব কিছু আলাদা নই। তবে মুখটা হয়ত একটু বেশি চ্যাপ্টা আর কপাল-ভ্রু বেশি উঁচু। তা কথা বলা যাবে কী? সম্ভবত না। কথা-বার্তা বলা যাবে না। তার মুখ থেকে কিছু আওয়াজ বের হলেও তার থেকে কোনো অর্থ বের করা সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ সে আগুন দেখে চমকাবে না। চাই কী, দু-একবার দেখিয়ে দিলে দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুনও জ্বালাতে পারবে। বাড়ির মিক্সি চালাতে না পারলেও শিল-নোড়া, হামন-দিস্তা, যাঁতাকল দেখিয়ে দিলে কয়েকবার গোত্তা খেয়ে ব্যবহার করতে পারতেও পারে।

কিন্তু এর সবটাই একেবারেই গাঁজাখুরী ভাবনা। বাস্তবে কোনো হোমো-ইরেক্টাসের সঙ্গে দেখা হবার কোনো সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আজ থেকে আন্দাজ কুড়ি লক্ষ বৎসর আগেই তারা নেই হয়ে গেছে। পুথিবীতে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। কেন নেই হয়ে গেল সেটাও গোলমেলে। মানে খুব জোর দিয়ে কেউ পাক্কা কোনো কারণ বলতে পারে নি।
 
হোমো-ইরেক্টাস আর হোমো-স্যাপিয়েনস আদতে মানব জাতি হলেও আলাদা। প্রথমে হোমো-ইরেক্টাস তার পরে হোমো-স্যাপিয়েন। না হোমো-ইরেক্টাস থেকে উন্নততর হোমো-স্যাপিয়েনসদের উদ্ভব হলেও হোমো-ইরেক্টাসরা হোমো-স্যাপিয়েনসে বদলে যায় নি। অনেকটা আমাদের বাবা-মায়ের থেকে আমাদের জন্ম হলেও বাবা-মা তাদের মত করেই আলাদা থেকে গেছেন। তারা এখনো হয়ত পিৎজার বদলে ভাত, বিরিয়ানির বদলে পান্তা ভাত বেশি পছন্দ করবেন।

তা আচমকা কেন হোমো-ইরেক্টাস পর্ব?
২০১৮ সালে কয়েকটি ঘটনায় তাদের নিয়ে জোরদার আলোচনা শুরু হয়েছে। সবাই আশা করে আছেন ২০১৯ এ আরো অনেক খবর পাওয়া যাবে। ২০১৮ তে ফিলিপিন্স আর চীন থেকে কিছু গরম গরম খবর আসে। তাতে আগের অনেক তত্ত্ব বদলে ফেলতে হবে বলেই সবার অনুমান। বিজ্ঞানের মজা এখানেই। নিত্য নতুন আবিস্কারের খবর আসে আর সবাই বলেন, যাঃ! যাহা জানিতাম তাহা ভুল জানিতাম।

আসলে ভুল কেহই জানিত না। তখনকার জানা তথ্যের ভিত্তিতে কিছু কম জানা ছিল। এবার নতুন তথ্য দিয়ে ফিল আপ দি ব্ল্যাঙ্ক। তাতে গোটা বাক্যের অর্থে অদল বদল হলেও হতে পারে কখনো সখনো। কিন্তু যা জানা গেল তা ধামা চাপা দিয়ে আগের বলা কথাই চালিয়ে যাওয়া বিজ্ঞান পছন্দ করে না।
 
হোমো-ইরেক্টাসদের প্রথম খোঁজ পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়াতে। ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে ইউজিন ডুবোস বের করেন। নাম দেয়া হয় ‘জাভা ম্যান’। তখন ডারউইনের মানব বিবর্তন মতবাদের প্রামান্য হিসাবে এই আবিস্কার খুব গুরুত্ব পেয়েছিল।

সম্প্রতি চীনের Loess plateau পাওয়া গেল আরেকটি ফসিল। সেটি হোমিনিন (হোমো-ইরেক্টাসদের আগের) না কী হোমো-ইরেক্টাস সেটা নিয়ে তর্ক চলছে। তবে সেটা যে ২০ লক্ষ ১০ হাজার বৎসর আগের তা নিয়ে তর্ক হচ্ছে না। ফলে এবার ধরে নিতেই হয় আজ থেকে আন্দাজ কম করেও চার লক্ষ বৎসর আগে হোমিনিনরা এশিয়াতেও ছিল। এছাড়া জর্জিয়ার ককেশাস এলাকায় পাওয়া গেছে ১ লক্ষ ৮০ হাজার বৎসর আগের হোমো-ইরেক্টাসদের উপস্থিতির প্রমাণ।

এতদিন ভাবা হচ্ছিল আধুনিক মানুষ হোমো-স্যাপিয়েনসদের পরে পরেই হোমো-ইরেক্টাসরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ইন্দোনেশিয়াতে হোমো-ইরেক্টাসদের উপস্থিতি আজ থেকে ৪০ হাজার বৎসর আগেও ছিল, এমন প্রমান পাওয়া গেছে। তাহলে ধরে নিতে হয় কোনো একসময় হোমো-ইরেক্টাস আর হোমো-স্যাপিয়েনস পাশা পাশি বসবাস করেছে, অন্তত ইন্দোনেশিয়ার কিছু এলাকায়।

আধুনিক মানুষ হোমো-স্যাপিয়েনসদের আগে হোমো-ইরেক্টাসরাই প্রথম আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ক্রমে গোটা পৃথিবীতে বসবাস করতে শুরু করে। আজ থেকে ২০ লক্ষ বৎসর আগে আবহাওয়ার পরিবর্তনে পৃথিবী জুড়ে ঘাস ভরা বিশাল তৃণভুমির উদ্ভব হয়। এই তৃণভুমিতে ঘুরে বেড়াত নানা তৃণভোজী প্রাণী। তৃণের অভাব নেই তাই তৃণভোজীর সংখ্যা বাড়তেও কোনো অসুবিধা নেই। ফলে হোমো-ইরেক্টাসদের পক্ষে খাবার জোগাড় করা সহজ হয়ে গেল। সেই সুখে হোমো-ইরেক্টাসদেরও সংখ্যা বাড়ছিল। খাবারের খোঁজে এরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কম্পাস তো নেই, তাই দিক বুঝে বাড়ি ফেরারও বালাই নেই। তাদের যেমন ভোজনং যত্রতত্র, তেমনি শয়নংও যত্রতত্র।

এই কথায় প্রশ্ন আসে তারা খেত কী? গোশত? যদি তাই হবে তাহলে তারা নিশ্চয়ই দক্ষ শিকারীও ছিল। না এখানে এসে বিজ্ঞানীরা কিছুটা হলেও দ্বিমত। একদল বলেন তারা মুলত গোশতই খেত, আরেকদল বলেন তা নয় সবই খেত। যা পেত তাই খেত। শিকারী হিসাবে দক্ষতা বোধ হয় কমই ছিল। গোশত খেত অনেকটা হায়নার মত করে, বড় প্রাণীর ফেলে যাওয়া খাবার খেয়েই থাকতে হত এদের।

আগেকার হোমো প্রজাতির হোমিনিনদের চেয়ে হোমো-ইরেক্টাসদের চেহারা আধুনিক মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি মেলে। এরা হোমিনিনদের চেয়ে লম্বা ছিল, ফলে লম্বা লম্বা পা ফেলে অনেক বেশি দুরে যেতে পারত। তাদের শরীরের গঠনেও যে পরিবর্তন এসেছিল তাতে শরীরে বেশিক্ষণ জল ধরে রাখা সম্ভব। তাই খোলা মাঠে এন্তার হাঁটতে কম অসুবিধা। অতএব স্রেফ হেঁটে হেঁটেই গোটা দুনিয়া দখল করে ফেলল। আগে ভাবা হত হোমো-ইরেক্টাসরা ভালো হাঁটতে পারলেও বড় নদী-টদী পার হতে পারত না। কিন্তু এখন ফিলিপিন্সের কয়েকটি দ্বীপে পাওয়া ফসিল দেখে বোঝা গেল, না; এরা নদীও পার হতে পারত। সেটা আধুনিক জাহাজ তো নয়ই সম্ভবত নৌকাও নয়। গাছের গুঁড়ি ইত্যাদি হতে পারে। সমুদ্র? এখনো বলা সম্ভব হয়নি।
 
আগেকার হোমিনিনদের চেয়ে এদের মগজের আয়তন বেশি ছিল। ফলে আস্তে আস্তে বুদ্ধি খাটিয়ে আগুন জ্বালানো, পাথরের টুকটাক অস্ত্র বানানো শিখে ফেলেছিল। তবে এরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য কথা বলতে পারত না। হাত পা নেড়ে, গাঁক গোঁক আওয়াজ করে কাজ চালিয়ে নিত। নিজেদের মধ্যে দল বেঁধে থাকার ব্যাপারেও এরা হোমিনিনদের চেয়ে অনেকটা উন্নতি করেছিল। কিন্তু ভাষার অভাবে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়েই থাকতে হত। ছবি আঁকতে পারত? না এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

হোমো-ইরেক্টাস বললে এখন যেমন সবাই বুঝতে পারি কাদের কথা বলা হচ্ছে, আগে কিন্তু তা ছিল না। আগে একগাদা আলাদা আলাদা নামে এদের নামাকরণ হয়েছিল। যেমন- Anthropopithecus, HomoLeakevi, Pithecanthropus Sinanthropus, Meganthropus, Talanthropus এতগুলো আলাদা আলাদা নামাকরণ হয়েছিল কারণ প্রথমে বোঝাই যায়নি এরা আসলে একই, শুধু সময়ে আর ভৌগলিক দুরত্বে চেহারায় বদল হয়ে গেছে। অনেকটা এখন যেমন হোমো-স্যাপিয়েন আধুনিক মানুষেরা আদতে এক হলেও দুনিয়া জোড়া কয়েকশ আলাদা আলাদা জাতি।

তাই এখন সব মিলিয়ে বলা হচ্ছে যাহা হোমো-এরগাষ্টার তাহাই হোমো-ইরেক্টাস। আর তাদেরই পরের প্রজন্মে আছে Homo-heidelbergenisis, Homo antecessors, Homo neanderthalensis, Homo Denisova আর অবশ্যই শেষের লেজ আমরা Homo sapiens

হোমো-ইরেক্টাসদের নিয়ে গবেষণা চলছে জোর কদমে। অনেক নতুন নতুন খবর আসবে। তবে মুশকিল হলো, এমনিতেই খুব কম পরিমানেই হোমো-ইরেক্টাস ফসিল পাওয়া গেছে তাছাড় এখনো কোনো হোমো-ইরেক্টাস DNA সংগ্রহ করা যায়নি। সেটা হলে অবশ্যই নতুন দরজা খুলে যাবে।

শেষ প্রশ্ন। ভারতে হোমো-ইরেক্টাসরা ছিল? হ্যাঁ ছিল।
ভারতে মধ্যপ্রদেশে পাওয়া ফসিল থেকে জানা গেল নর্মদা-ম্যান-এর কথা। তা এই নর্মদা-ম্যান হোমো-ইরেক্টাস না হোমো-স্যাপিয়েনস প্রজাতির তা নিয়ে অনেক তর্ক। ফসিল থেকে বলা হয় হোমো-ইরেক্টাস। কিন্তু যেখানে পাওয়া গেছে সেই এলাকার অন্যান্য জিনিষ দেখে একে অনেক আগের বলে অনুমান করা হয়। কত আগের? তা কেউ কেউ তো দাবী করেন ৫ লক্ষ বৎসর আগের। কিন্তু এই পোষ্ট ট্রুথের যুগে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে তা বলা বেশ কঠিন। এ নিয়ে পরে আলাদা করে লিখব। কারণ পাশে শ্রীলঙ্কাতেও ছিল।
 
তারও আগের হোমিনিন ছিল? হ্যাঁ ছিল।
প্রথমে দুটো প্রজাতির নাম বলা হত Shivapithecus, Ramapithecus পরে যোগ হয় Brahmapithecus কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোঝা যায় আদতে তিনটিই এক প্রজাতির। তাই Shivapithecus নামটাই থেকে গেল। এদের উচ্চতা মোটামুটি ১.৫ মিটার। বয়স, তা আনুমানিক ১ কোটি ২২ লক্ষ বৎসর।

নিউজওয়ান২৪/আ.রাফি