ঢাকা, ২৯ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ:

নয়ন মিন্নি’র ‘বাসর ঘর’, চুলসহ ২০ আলামত জব্দ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২৩ জুলাই ২০১৯  

আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি (ফাইল ছবি)

আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি (ফাইল ছবি)

নয়ন বন্ডের সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বিয়ের বিষয়টি এখনো রহস্য ঘেরা। মিন্নি এখনো নয়নের সঙ্গে তার বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করছেন। একইসঙ্গে বলছেন, তিনি নয়নের বাড়িতে থাকা বা যাওয়া-আসা করতেন না। 

যদিও বিয়ের কাজী, নয়নের মা ও নিহত রিফাত শরীফের বাবার দাবি করেছেন নয়ন-মিন্নির বিয়ে হয়েছিল।

নয়ন বন্ডের মায়ের দাবি, ‘মিন্নি নয়নের বউ হিসেবেই বাড়িতে অবাধে যাতায়াত করত। নয়ন-মিন্নি এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, তারা রীতিমতো ছোটখাটো সংসারও গড়ে তুলেছিল।’ মিন্নির সঙ্গে নয়নের সম্পর্কের নানা স্মৃতিও প্রতিবেদককে দেখান নয়নের মা।

বরগুনা সরকারি কলেজ লাগোয়া নয়নের বাড়ি। বাড়িতে টিনের চালা দেয়া ৩টি ঘর। সোমবার (২২ জুলাই) ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির কাঠের দরজাটি বন্ধ। দরজায় ধাক্কা দিতেই সেটি খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, নয়নের মা সাহিদা বেগম ঘরে একা আছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নয়নের মা বলেন, ‘আমার ছেলেটা হারিয়ে গেছে এই মিন্নির কারণেই। আসেন... এই ঘরে আসেন। নয়ন এই ঘরেই থাকত। পুলিশ এখান থেকে মিন্নির ব্যবহার করা অনেক কিছুই নিয়ে গেছে। এরপরও কিছু জিনিস পড়ে আছে।’

দেখা গেল, নয়নের ঘরে প্রবেশের দরজায় বড় করে লেখা ‘বাসর ঘর’। মিন্নি এসে ‘বাসর ঘর’ নামক এই ঘরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দরজা বন্দ করে নয়নের সঙ্গে থাকত।

দেয়ালের কয়েকটি জায়গায় ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘এন প্লাস এম’। অর্থাৎ নয়ন যোগ মিন্নি। আরেক জায়গায় লেখা ‘আই লাভ ইউ এন প্লাস এম।’ দেয়ালের আরো কয়েকটি লেখা কে বা কারা কালো কালির স্প্রে দিয়ে মুছে দিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্র প্রায় সবই ভাঙা।

নয়নের মা বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি বাড়িতে ছিলাম না। নয়নকে ধরার জন্য পুলিশ বাড়িতে এসে কিছুই রাখেনি। সব ভেঙে দিয়েছে। ভাঙা ড্রেসিং টেবিল দেখিয়ে তিনি বলেন, এটার কাচ পুলিশ ভেঙে দিয়েছে। এই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মিন্নি অনেক সাজগোজ করেছে। ভাঙা ড্রয়ার খুলে তিনি বের করেন একটি ফেস পাউডারের খালি কৌটা। নয়নের মা বলেন, কৌটাটা পড়ে আছে।’

‘পাউডারসহ ওপরের অংশ নিয়ে গেছে পুলিশ। ঘরের এক কোণে একটা প্লাস্টিকের ফুলসহ ফুলদানি রাখা। র‌্যাপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো। সেটা দেখিয়ে তিনি বলেন, নয়নের জন্মদিনে এটা মিন্নি দিয়েছিল। ওই জন্মদিনের ভিডিও নাকি মোবাইলে ছাড়া হয়েছে। ইউটিউব না কিসে যেন এখনো আছে। সবাই দেখেছে।’

এ-ঘর, ও-ঘর ঘুরিয়ে একটা ভাঙা কম্পিউটার টেবিলের সামনে নিয়ে তিনি দেখান কয়েকটি মোবাইল ফোনের ভাঙা টুকরো। যেগুলোর খাপটাই শুধু আছে। মাদারবোর্ড ও সিমকার্ড নিয়ে গেছে পুলিশ। নয়নের মা বলেন, পুলিশ যে মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে গেছে তাতে নয়নের সঙ্গে মিন্নির অনেক ছবি ছিল।

এরপর নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোনের গ্যালারি খুলে কয়েকটি ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘মিন্নি প্রায় প্রতিদিনই এ বাড়িতে চলে আসত।’ কলেজের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষা একটা সরু গলি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই গলি দিয়ে সে হেঁটে চলে আসত।’ গলিতে দাঁড়ানো মিন্নির হাস্যোজ্জ্বল ছবিও দেখান তিনি।

আরেকটা ছবিতে নয়নের সঙ্গে মিন্নির ভিডিও চ্যাটের স্ক্রিন শট দেখিয়ে নয়নের মা বলেন, ‘তারা তো সব সময় ভিডিওতে কথা বলত। এই দেখেন ছবি।’ এতে দেখা যায়, নয়নের চ্যাটিং মেসেঞ্জার প্রোফাইলে মিন্নির ছবি দিয়ে লেখা ‘বউ’। আর মিন্নির চ্যাটিং প্রোফাইলে লেখা এএস মিন্নি অর্থাৎ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।

এসব দেখিয়ে নয়নের মা বলেন, ‘পুলিশ প্রায় সবকিছুই নিয়ে গেছে। আমার কাছে এগুলোই অবশিষ্ট আছে। তিনি বলেন, এগুলো আমার কাছে থাকার কথাও নয়। একদিন নয়নের মোবাইলের স্ক্রিন টাচ (পরদা) নষ্ট হয়ে গেলে কিছুদিন আমার ফোনটা ব্যবহার করে। পরে আমাকে যখন মোবাইল ফিরিয়ে দেয় তখন এই ছবিগুলো ছিল।’

বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, নয়নের ঘরে সাদা দেয়ালে লাল রং দিয়ে এক জায়গায় লেখা ০০৭ (নয়নের সন্ত্রাসী গ্রুপের সাংকেতিক নাম)। সাহিদা বেগম বলেন, নয়ন কেন তার নামের সঙ্গে বন্ড বা ০০৭ সেভেন লিখত তা আমি জানি না। সে বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু তাকে তো মেরেই ফেলল।

কিন্তু যারা তাকে বন্ড বানাল তাদের কী কিছুই হবে না। যারা তাকে নয়ন থেকে নয়ন বন্ড বানিয়েছে তাদেরও ধরা হোক। যাতে আর কোনো নয়ন বিপথগামী সন্ত্রাসী বা বন্ড না হতে পারে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নয়নের বাড়ি থেকে অন্তত ২০ ধরনের আলামত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে নয়নের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বেশকিছু ছবি, মিন্নির ব্যবহার করা লিপস্টিক, চিরুনি, চিরুনিতে আটকে থাকা মিন্নির চুল, কামিজ, চুলের ক্লিপ, ফেসপাউডার, চোখের ভ্রূতে ব্যবহৃত আই ব্রো, সিমকার্ড এবং কয়েকটি মোবাইল ফোনসেট।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরগুনা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, নয়নের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠতা ও বিয়ে প্রমাণ করতেই এসব আলামত জব্দ করা হয়েছে। নয়নের বাড়ির চিরুনিতে আটকে থাকা মিন্নির চুল ও তার ব্যবহৃত কয়েকটি জিনিস ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হবে।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, মিন্নি যেহেতু বারবারই নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন তাই কিছু অকাট্য প্রমাণের প্রয়োজন। রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করা গেলে রিফাত হত্যার জট অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার মাইঠা এলাকার বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য রেকর্ড করতে বরগুনা পুলিশ লাইনসে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পর দিন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আদালতে মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী।

পর দিন বৃহস্পতিবার বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

এর পর শুক্রবার বিকালে মিন্নি একই আদালতে তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এ দিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের দাবি, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তিনি এ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে (মিন্নি) আসামি করা ও রিমান্ডে নেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দায়ী করে আসছেন। 

শুক্রবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছুই শম্ভু বাবুর খেলা। তার ছেলে সুনাম দেবনাথকে রক্ষা করার জন্য আমার মেয়েকে বলি দেয়া হচ্ছে।’ শম্ভুর ছেলে সুনামের বিরুদ্ধে কিশোরের অভিযোগ, তার জন্যই এতদিন মিন্নির পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি আইনজীবীরা। 

এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সমালোচনার পর বরগুনা ও ঢাকার আইনজীবীদের একটি অংশ মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।

বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। বিকেল ৪টায় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। পরে দ্বিতীয় একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হত্যায় মিন্নির সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

২৭ জুন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনের নামে এবং চার-পাঁচজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই ভোরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

নিউজওযান২৪.কম/এমজেড

আরও পড়ুন
স্বদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত