ঢাকা, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ:
টানা পাঁচদিন বৃষ্টির আভাস মুসলিম বিশ্বকে ‘ন্যাটো-ধাঁচের’ নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের প্রস্তাব তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে চীন

নভেম্বর রেইন

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ৬ নভেম্বর ২০১৮  

ছবি: লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

ছবি: লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

 

মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, ঠিক তেমনি আমার প্রকৃতি দর্শনও। মহাখালী ডি ও এইচ এস, ঢাকা সেনানিবাসের আবাসিক এলাকার লেইক পাড়ের পায়ে চলার পথের মধ্যেই সীমিত। প্রায় প্রতিদিন সকালে সূর্য উঠার পূর্বে আমি এই পথে হাঁটি। ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা। অতঃপর বাসায় ফিরে এসে ছোট মেয়ে রাইয়াকে স্কুলে দিয়ে আসি। হেঁটে অথবা রিক্সায় করে। এভাবেই শুরু হয় আমার প্রাত্যহিকের জীবন।

প্রকৃতিতে কখন ঋতু বদলায় তাও আমি বুঝতে পারি লেইক পাড়ের পথের পাশের গাছপালা থেকে। এই গাছপালাগুলোর অধিকাংশই গুল্ম জাতীয়। সুতরাং প্রতিবছর এদেরকে আপনি দেখতে পাবেন না। ফুলের ঋতু অতিক্রান্ত হবার পরই এরা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় অন্য কোনো গুল্ম জাতীয় গাছ দ্বারা। তবে ক্ষণস্থায়ী হলেও এরা আপনার মনকে ক্ষণকালের জন্যে আনন্দিত বা বিহ্বল করতে সক্ষম।

লেকের লোহার প্রাচীরের উত্তরে সেনাবাহিনীর ইউনিটের মাঠ। মাঠের ঘাসগুলোকে কেটে কেটে ছোট করে রাখা হয়েছে। রিক্রুটদের মাথার চুলের মতো। প্রতিদিন সকালে সেনাসদস্যরা পিটি, ব্যাটল পিটি এবং এসল্ট কোর্স করে। পার্থক্য আমাদের সঙ্গে এদের গতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশী। পিটির পর প্রায় প্রতিদিনই বিউগল বেজে উঠে। তখন তারা পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে যায়।

আমার ধারণা এই পথে প্রতি প্রত্যূষে যাদের পদচারণা, তাদের অধিকাংশ জনেরই প্রকৃতি দেখার বাতিক নেই। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার ছাড়া অবশিষ্ট সকলেই ব্যবসায়ী। বাসা ক্রয় বা ভাড়া করে এই এলাকায় বাস করেন। এই দল দ্রুত চক্কর দিতে থাকেন লেকের চারপাশে। হয়তোবা অসুখের কারণে। অথবা ব্যবসার কাজে ছুটে যাবার জন্যে। প্রতি সকালেই আমি খেয়াল করি এই বর্ষীয়ান মানুষেরা দ্রুত পায়ে আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে মহিলারাও আছেন। প্রায় সপ্তাহেই দেখি মাইকে করে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে অমুক বাসার অমুক মৃত্যু বরণ করেছেন। অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে। পার্থিব অনিত্যতা তখন আমাকেও গ্রাস করতে থাকে।

আজ সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে বাসার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতেই দেখি বাইরে বৃষ্টি। মুষলধারে না হলেও কম ঝড়ছে না! সাথে অদ্ভূত সব টুপুরটাপুর শব্দ। মৃদঙ্গের মতো। ছেলেবেলার বৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দিলো। ছেলেবেলায় প্রতিবছরই এই সময়ে বৃষ্টি হতো। নভেম্বর মাসে। অথবা হেমন্তকালের শেষের দিকে। সাধারণত সাগরের নিম্নচাপ থেকে এই বৃষ্টি। এই বৃষ্টির অব্যবহিত পরেই নেমে আসতো প্রবল কনকনে শীত। নতুন কিছু নয়। পার্থক্য একটাই যে, এখনকার বৃষ্টির পরে শীত নামে না। কয়েকদিন আগেও এমন বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রকৃতির নিয়মকানুন বদলে গেছে।

ঠিক দেড় ঘন্টা পর বৃষ্টি থামলো। কী কারণে আমার মেয়ের আজ ক্লাস নেই। সে তার মায়ের সাথে ঘুমোচ্ছে। সকাল ৯টা পর্যন্ত ঘুমোবে। ফলে অফিসের জন্যে প্রস্তুত হবার পূর্বে আমার হাতে আরো এক ঘন্টা সময় আছে। এই সময়ে আমি লেকের পাড় থেকে ঘুরে আসতে পারি। পথে বের হতেই মার্কিন রক ব্যান্ড 'গানস এন রোজেস' এর বিখ্যাত 'নভেম্বর রেইন' গানটির কথা মনে পড়ে গেলো। কয়েকদিন পূর্বে ইউটিউব থেকে গানটি আমি শুনেছিলাম। ফেসবুকের বদৌলতে জানলাম যে, ১৯৯২ সনে গানটি রিলিজ হয়। কালজয়ী গান। মানবীয় সম্পর্কের শীতলতা বোঝাতে গানটিতে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয় নভেম্বরের বৃষ্টিকে!

আমার বাসার সামনেই একটা কড়ই গাছ (শিরিষ গাছ)। গত কয়েকদিন থেকেই হলুদ ফুলে ছেয়েছিলো। বৃষ্টির কারণে ফুলের হলুদ পাপড়িগুলো ঝরে গেছে। পড়ে আছে রাস্তার উপরে। বৃষ্টির জলের পাশে। দূর থেকে দেখতে জায়নামাজের মতো মনে হয়। বৃষ্টির কারণে চারপাশের পরিবেশ খুবই পরিচ্ছন্ন।

লেক পাড়ের পথের উপরে শুকনো গাছের পাতা ঝরে পড়ে আছে। সিক্ত। কয়েকদিন ধরে প্রকৃতিতে যে শুষ্কতা এসেছিলো হঠাৎ করে তা উধাও। প্রাচীরের ওপাশে সেনাবাহিনীর সদস্যেরা সবজীর বাগান করছে। বৃষ্টি অথবা প্রখর রোদে সেগুলো যাতে নুয়ে না যায়, সেজন্যে চারাগাছের উপরে বাঁশের তৈরী টুকরী দিয়ে অর্ধেক ঢেকে রেখেছে।

বৃষ্টিতে ভিজে একটা রঙ্গন গাছ ভিউ কার্ডের ছবির মতো চিকচিক করছে। লেকের দক্ষিণ পাশে দুইটা হলুদ গাছ। প্রচুর ফুল ফুটেছে। এই রঙে দক্ষিণ দিকটা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। নাম জানি না। এখানে দাঁড়ালে আপনার মূহুর্তের জন্যে শীতের দেশের ফল (Fall) এর কথা মনে পড়ে যাবে। তবে গাছটা পাতা ঝরা বৃক্ষ নয়। আমাদের দেশের অথবা বিদেশের চিরহরিৎ গাছ। রঙ পরিবর্তন করবে না। শীতের সময়ে প্রথমে এর ফুল ঝরে পড়বে। অতঃপর শুকনো পাতা ঝরে পড়বে এর থেকে। গত বছর এই গাছের সংখ্যা ছিলো ৪ টা। দুটো মরে গেছে। আমি মালিদের দেখেছি গাছদুটোর শিকড় উপড়ে ফেলতে। একটা ফুলের গাছের পাতার উপরে শিশির জমে আছে। আকাশে মেঘ নেই। তবে বিষন্নতার মতো কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে। একটা গুমোট গরম। এভাবেই হয়তো বা কয়েকদিন পর শীত এসে যাবে!

“Nothin' lasts forever
And we both know hearts can change
And it's hard to hold a candle
In the cold November rain”

লেখক: সাবেক মেজর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

নিউজওয়ান২৪/টিআর

আরও পড়ুন
অসম্পাদিত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত