ঢাকা, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

শ্রদ্ধাঞ্জলী: বর্ণবাদবিরোধী বিদ্রোহী বীর ‘আলী দি গ্রেট’

ক্রীড়া ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০:৪২, ৪ জুন ২০১৬   আপডেট: ১৩:৫৩, ৯ জুন ২০১৬

ভূপাতিত সনি লিস্টন এবং নকআউট! প্রথম হেভিওয়েট খেতাব জয়ী আলীর উল্লাসটা ছিল বাঁধভাঙ্গা

ভূপাতিত সনি লিস্টন এবং নকআউট! প্রথম হেভিওয়েট খেতাব জয়ী আলীর উল্লাসটা ছিল বাঁধভাঙ্গা

৭৪ বছর বয়সে মারা গেলেন সর্বকালের সবশ্রেষ্ঠ বক্সার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী (জন্ম ২৫/০২/১৯৬৪ মৃত্যু ০৫/০৬/২০১৬)। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ বক্সার মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন।

তিনি ১৯৭৮ সালে সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফর করে প্রভূত ভালবাসা পান। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছিল বাংলা গান ‘আলী আলী মোহাম্মদ আলী/ এই দুনিয়ায় জিন্দাবাদ/ কালোপাহাড় মোহাম্মদ আলী...’। তার সম্মানে তখন ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায় বক্সিং স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয় মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম। তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্বও দেওয়া হয়। দুনিয়ার অসংখ্য দেশ ঘুরে দেখা আলী বাংলাদেশ সফর শেষ করে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, “এত ভালবাসা আর কোথাও পাইনি।” এখানে নিউজওয়ান২৪.কম পাঠকদের জন্য বাংলাদেশের সব মানুষের প্রিয় আলীর জীবনের কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো

শ্রদ্ধাঞ্জলী: বর্ণবাদবিরোধী বিদ্রোহী বীর ‘আলী দি গ্রেট’

বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের প্রিয়মুখ, অবহেলিত পিছিয়ে পড়া মানুষদের সংগ্রাম-সাফল্যের আইকন ছিলেন মোহাম্মদ আলী। তার জীবন কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে বেস্ট সেলার সিনেমা, নাটক, জীবন কাহিনী।

এফবিআই যে লড়াইকে ভেবেছিল ‘পাতানো’
১৯৬৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। ফ্লোরিডার মায়ামি বিচে ২২ বছর বয়সী দুর্বিনীত অসীম তেজী যুবকের ক্যাসিয়াস ক্লের প্রবল দাপটে যেন বক্সিং রিংয়ে বারুদের বিস্ফোরণ হচ্ছিল একের পর এক। মনে হচ্ছিল তরুণ আলী বুঝি বক্সিং শেখাচ্ছেন অভিজ্ঞ এই হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নকে। একপর্যায়ে বেপরোয়া যুবক আলীর মুষ্টিহুলে ধরাশায়ী হন তখনকার বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপাধারী সনি লিস্টন।

পুরো বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের চোখ কপালে উঠে যায়। প্রতিপক্ষের কাছে সনি একজন ভীতিকর লড়িয়ে ছিলেন। তারওপর তার মুষ্টির ঘের ছিল ১৪ ইঞ্চি যা একটি আলোচিত প্রসঙ্গ ছিল। এমন মুষ্টির মুখে পড়ে যে কারও ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হতো। কিন্তু ক্যাসিয়অস ক্লের প্রবল প্রতাপের কাছে সনি লিস্টন উড়ে গেলেন যেন খড়কুটোর মতো। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ওই লড়াইকে পাতানো বলে সন্দেহে করেছিল এবং এ নিয়ে খোঁজ-খবরও করে তারা। পরবর্তীতে এফবিআইর গোপন নথি সূত্রে একথা জানা যায়।

সেই ক্যাসিয়াস ক্লে
১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ আলী প্রথম জীবনে পরিচিত ছিলেন ক্যাসিয়াস ক্লে নামে (পুরো নাম ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে, জুনিয়র)। পেশাদার হেভিওয়েট বক্সিংয়ে অসাধারণ সব কীর্তি তাকে পরিণত করেছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা বক্সিং তারকায়। বিশ্বখেতাবের তিনবারের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন আলী অলিম্পিক স্বর্নজয় করেন ১৯৬০ সালে।

সেই লাল-সাদা বাইসাইকেল
আলী তখন স্কুলছাত্র। তার প্রিয় একটি বাইসাইকেল ছিল লাল-সাদা রঙের। একদিন সাইকলেটি চুরি যায়। ছুটে যান থানায় অভিযোগ জানাতে। সেখানে পরিচয় হয় পুলিশ কর্মকর্তা বক্সার জো মার্টিনের সঙ্গে। ১২ বছর বয়সী প্রতিবাদী ছেলেটি জানায়, সে চোরকে পেলে পিটিয়ে তক্তা বানাবে। একথা শুনে জো মার্টিন বললেন, এটা করতে হলে আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, শিখতে হবে রাড়াইয়ের কৌশল। বালকটির চোখের বারুদ আর আগ্রহের অসীমতা উপলব্ধি করে তিনি তখনি তাকে নিজের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। ওই চোরকে নাগালে না পেলেও এরপর মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় জীবনের প্রথম খেতাব জেতেন মোহাম্মদ আলী ওরফে ক্যাসিয়াস ক্লে।



খ্যাতিমান সব প্রতিদ্বন্দ্বীরা
বক্সিং রিংয়ে আক্রমণাত্মক এবং অতি কৌশলী এই বক্সিংগুরুর খেলাটিতে নিজের স্টাইল সম্পর্কে একটি উক্তি খুব বিখ্যাত ছিল। তা হলো, ‘প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে হুল ফোটাও মৌমাছির ছন্দে’ (ফ্লট লাইক অ্যা বাটারফ্লাই, স্টিং লাইক এ বি)। তার অনেক বিখ্যাত উক্তির আরেকটি হচ্ছে- জীবনে যে ঝুঁকি নিতে ভয় পায় তার জীবন ব্যর্থতারই নামান্তর।

বিশ্ব ক্রীড়া ইতিহাসে একজন সর্বসেরা হিসেবে বিবেচিত বক্সার আলীর প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিলেন বক্সিং জগতের একেক জন মহীরুহ। এদের শীর্ষ কয়েকজন হলেন- জো ফ্রেজিয়ার, জর্জ ফোরম্যান, সনি লিস্টন। এছাড়া জাপানি কুস্তিগীর ইনোকির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তিনি জাপানে গিয়ে তার মোকাবেলা করেন। ভিন্ন ধারার জুজুৎসু-কুস্তি-কারাতে কৌশলে ওস্তাদ ইনোকির সঙ্গে তার বহুল আলোচিত ওই লড়াই ড্র হয়েছিল। ইনোকির পায়ের বাঁকানো লাথিতে আলীর পায়ের পেছনের মাংশপেশী ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। অপরদিকে আলীও তাকে হুলফেটানো ঘুষিতে বিপর্যন্ত করে তোলেন।

গ্লোভসের দাম পুরস্কারের চেয়ে বেশি
যে গ্লোভসটি পড়ে ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে প্রথম হেভিওয়েট খেতাব জেতেন, ৫০ বছর পর সেই গ্লোভসটি কিনে নেন এক ভক্ত আট লাখ ৩৬ হাজার ডলারের বিনিময়ে। মজার ব্যাপার হলো আলী সাত রাউন্ডের ওই লড়াইয়ে সনি লিস্টনকে টেকনিক্যালি নকআউট করে যে অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন এটা তারচে ২ লাখ ৬ হাজার ডলার বেশি ছিল।

রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল: দ্য গ্রেটেস্ট বাউট
আলীর জীবনের লড়াইগুলোর মধ্যে সবসেরা বা অন্যতম বিখ্যাত বলা যায় ১৯৭৪ সালে আফ্রিকার জায়ারের রাজধানী কিনসাসায় অনুষ্ঠিত ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ হিসেবে খ্যাত লড়াইটি। ২৫ বছর বয়সী মারকুটে জর্জ ফেরম্যানের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হন সাত বছর আগে হারানো খেতাম পুনরুদ্ধারে। বিশ্বব্যাপী নিজের দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রচারের লক্ষে খেলাটি জায়ারেতে আয়োজন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট মবুতু সেসে সেকো। এজন্য আলী আর ফেরম্যান প্রত্যেককে ওই সময়ের মুদ্রায় ৫০লাখ ডলার করে দিয়েছিলেন মবুতু। ওই লড়াইয়ে পুরনো চাল আলী টগবগে তরুণ-তুর্কী ফোরম্যানকে রীতিমতো ছাতু করে দেন ঘুষিয়ে। আট রাউন্ডের মাথায় জর্জ ফেরম্যান নকআউট হন- আলী ফিরে পান তার খেতাব।    

বর্ণবাদের প্রতিবাদে মেডেল বিসর্জন!
১৮ বছর বয়সে হাই স্কুল গ্রাজুয়েট পাস করার পর রোম অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েটে স্বর্ণ জয় করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে আলী লিখেছিলেন, তিনি নিজ শহরেও বর্ণবাদের শিকার হতেন। এর প্রতিবাদে সেবার খেতাব জিতে আসার পর লু্ইসভিল শহরের ওহাইও নদীর ওপরের একটি ব্রিজ থেকে স্বর্ণপদকটি তিনি ছুরে ফেলে দেন নদীতে। তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই বলেন আলী তার মেডেলটি আসলে হারিয়ে ফেলেছিলেন। যাহোক, ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকের উদ্বোধনী মশাল প্রজ্জ্বালনকারীর সম্মান দেওয়া হয় আলীকে। সেসময় তাকে ১৯৬০ সালের সেই আলোচিত পদকের একটি প্রতিরূপ (রেপ্লিকা) উপহার দেয় অলিম্পিক কমিটি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকৃতি ও কারাবরণ
১৯৬৭ সালে মার্কিন সেনাসদস্য হিসেবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পাঠাতে চায় তাকে সরকার। কিন্তু ধর্মীয় কারণে ওই যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করলে আলীকে যেতে হয় জেলে এবং রাতারাতি কেড়ে নেওয়া হয় তার খেতাব। ১০ হাজার ডলার জরিমানাসহ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের মুখে পড়েন। নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাথলেটিক কমিশন বাতিল করে তার বক্সিং লাইসেন্সও। তবে আপিল সূত্রে পরে তিনি ছাড়া পান এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বক্সিং লাইসেন্সও ফেরত পান। ১৯৭০ সালের অক্টোবরে রিংয়ে ফিরে জেরি কোয়ারিকে নক আউট করার মাধ্যমে ছিনিয়ে আনেন হারানো খেতাবও।



স্ত্রী-সন্তান
আলীর সন্তানদের মধ্যে লায়লা আলী একজন শীর্ষ নারী বক্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অপর সন্তানরা হচ্ছেন- রাশেদা আলী, হানা আলী, আসাদ আমিন, মারিয়াম আলী, জামিলা আলী, খালিয়া আলী, মোহাম্মদ আলী জুনিয়র ও মিয়া আলী।

তার সর্বশেষ স্ত্রী ছিলেন ইয়োলন্ডা উইলিয়ামস যাকে বিয়ে করেন ১৯৮৬ সালে। সাবেক স্ত্রীদের মধ্যে আছেন, সনজি রই (বিয়ে ১৯৬৪), বেলিন্ডা বয়েড (বিয়ে ১৯৬৭) ও ভেরোনিকা পোরশচে আলী (বিয়ে ১৯৭৭)। আলীর বাংলাদেশ সফরকালে সঙ্গে ছিলেন তখনকার স্ত্রী ভেরোনিকা।
 
নাম পরিবর্তন ও ধর্মান্তর
১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনেকে পরাজিত করে বিশ্ব খেতাবধারী হওয়ার পরদিন সকালে ঘোষণা করেন তিনি ন্যাশন অব ইসলাম নামের সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। তিনি আরও জানান যে তিনি তার ক্যাসিয়াস ক্লে নাম থেকে ‘ক্লে’ অংশটি বাদ দিচ্ছেন কারণ এই শব্দটি কৃতদাসত্বের পরিচয়ধারী।

ন্যাশন অব ইসলাম নেতা আলীজা মোহাম্মদ তার জন্য একটি নয়া নাম ঠিক না করা পর্যন্ত তিনি ‘ক্যাসিয়াস এক্স’ হিসেবে পরিচিত হবেন বলেও ঘোষণা করেন তখন।

১৯৬৪ সালের ৬ মার্চ থেকে মুসলিম নাম ‘মোহাম্মদ আলী’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। প্রসঙ্গত, তার পূর্বপুরুষ কৃতদাস ছিলেন। এছাড়া তাদের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা তথা বর্ণবাদ বিরোধী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। পিতার দিক থেকে আফ্রিকান আর মায়ের দিক থেকে কিছুটা আইরিশ ছিলেন আলী।

নিজক্ষেত্রে সাফল্যের বরপুত্র আলী গত ৩২ বছর ধরে ভুগছিলেন দুরারোগ্য পারকিনসন রোগে।

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

চলে গেলেন ‘আলী আলী মোহাম্মদ আলী’

খেলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত