ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শারীরিক গঠন-প্রকৃতি...

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২৫, ১ নভেম্বর ২০১৯  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বহু সংখ্যক সাহাবী অনেক চমকপ্রদ বিবরণ দিয়েছেন। আজকে এ লেখাতে পাঠকদের জন্যে রাসূল (সা.) এর দেহ কাঠামো ও সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হলো।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সর্বোত্তম গঠনপ্রণালিতে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত সৃষ্টির ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেন নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। 

সৌন্দর্যের সকল দিক যেন পূর্ণতা পেয়েছিল তাঁর মাঝে। আসুন, জেনে নিই কেমন ছিল নবীজির (সা.) শারীরিক গঠন-প্রকৃতি- 

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহা মানব আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। চরিত্রের দিক দিয়ে যেমন রাসূল (সা.) এর সমাক্ষ কেউ ছিল না তেমনি দৈহিক গঠনের দিক দিয়েও নয়।

ফলে পৃথিবীর মহা মানব হিসেবে কেমন ছিল তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য এবং গঠন এটা জানার আকাঙ্ক্ষা কম বেশি আমাদের সবার আছে।

দৈহিক সৌন্দর্য এবং কাঠামো:
এক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয়, আবু কারসানার মা এবং খালা আবু কারাসানার সঙ্গে রাসূল (সা.) এর কাছে বায়াতের জন্য আসেন। অতঃপর ফিরে যাওয়ার পথে তারা বললেন, ‘আমরা এমন সুদর্শন মানুষ আর দেখিনি। আমরা তাঁর মুখ থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি।’ (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ১/২৫৫)।

ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারছেন। যদিও রাসূল (সা.) এর পবিত্র সৌন্দর্যের যথাযথ বর্ণনা করা অসম্ভব। তাইতো ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি স্বরূপে আমাদের মাঝে আবির্ভূত হতেন, তাহলে তাঁকে অবলোকন করা কারুর পক্ষেই সম্ভব হত না। (খাসায়েলে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – মুফতি সুলাইমান)। 

কিন্তু তারপরেও চেষ্টা করেছি বিভিন্ন উৎস থেকে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য নিয়ে সামান্য কিছু লেখার।

উচ্চতা:
হজরত আলী (রা.) ও হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) রাসূল (সা.) এর দেহাবয়বের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) অধিক লম্বাও ছিলেন না, আবার অতি বেটেও ছিলেন না। তবে মাঝারি গড়নের লোকদের মত ছিলেন। (বোখারী শরীফ: ১/৫০২)।

রাসূল (সা.) ছিলেন মাঝারি গড়নের। এত বেঁটে ছিলেন না যে, গণনার বাইরে। আবার এত লম্বাও ছিলেন না যে, দৃষ্টি কটু। যেন দু’টি ডালার মধ্যে তৃতীয় একটি ডালা, যা তিনটি ডালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন। (যাদুল মা’আদ:৫৪)।

বর্ণ:
বর্ণ বলতে মূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়ের রং বোঝানো হয়েছে। বর্ণের ব্যাপারে অনেক বর্ণনা এসেছে যেমন:

হজরত আবু তোফায়েল বলেন, তিনি ছিলেন গৌর রং-এর, চেহারা ছিল মোলায়েম। তাঁর উচ্চতা ছিল মাঝারি ধরনের। (সহিহ মুসলিম: ২/২৫৮)।

হজরত আনার (রা.) বলেন, তিনি আযহারুল লাউন তথা লালিমা মিশ্রিত শ্বেত বর্ণের অধিকারী ছিলেন। (বোখারী শরীফ: ১/৫০২)।

হজরত আলী (রা.) বলেন, তিনি সুন্দর গোলাপি বর্ণের ছিলেন। (শামায়েলে তিরমিযী)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, তিনি এত সুন্দর, নান্দনিক এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলেন যেন তাঁর পবিত্র দেহখানা পূর্ণিমার চন্দ্র দ্বারা ধৌত করা হয়েছে।  (শামায়েলে তিরমিযী)।

মুখ ও মুখমণ্ডল মোবারক:
হজরত বারা ইবনে আযেব (রা.)- কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা কি তলোয়ারের মতো ছিল? তিনি বললেন, না বরং তাঁর চেহারা ছিল চাঁদের মতো। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা ছিল গোলাকার। (সহীহ বোখারী : ১/৫০২, সহীহ মুসলিম ২/২৫৯)।

রবি বিনতে মোয়াওয়েয (রা.) বলেন, তোমরা যদি রাসূল (সা.)-কে দেখতে, তখন মনে হতো যে, যেন উদিত সূর্যকে দেখছ। (মোসনাদে দারেমী, মেশকাত ২/৫১৭)।

জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ প্রশস্ত ছিল। (সিরাতে মুহাম্মদে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাহেব কাসেমী)।

দাঁত মোবারক:
হযরত হিন্দ ইবনে আবি হালা (রাযি.) বলেন, তিনি মুফালি জুল আস্নান অর্থাৎ দন্ত মোবারক চিকন ছিল এবং এর মধ্যে সামনের দাঁতগুলোর মাঝে একটু ফাঁক ছিল। শুভ্রতার ব্যাপারে অন্যস্থানে বলেন, মুচকি হাসির সময় তাঁর দাঁত মোবারক শিলাখন্ডের ন্যায় সাদা চকচক করে উঠত।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, তাঁর সম্মুখের দাঁতগুলি পৃথক পৃথক ছিল। অর্থাৎ মাঝে ফাঁক ছিল, ঘন ছিল না। যখন তিনি কথা বলতেন, তখন এই দাঁত মোবারক হতে যেন নূর ঠিকরে পড়ত। (মেশকাত শরীফ ২য় খন্ড, ৫৭১ পৃষ্ঠা)।

চোখ, নাক ও গাল মোবারক:
হযরত আলী রা বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ কালো এবং লম্বা পলক ছিল।

নাক মোবারকের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিন্দ ইবনে আবী হালা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলের নাক খানিকটা উঁচু , তার উপর জ্যোতির্ময় চমক। আর এ জন্য প্রথম দৃষ্টিতে বড় মনে হয়। গাল ছিল হালকা ও সমতল এবং নিচের দিকে একটু মাংসাল। (সিরাতে মুহাম্মদে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাহেব কাসেমী)। 

ঘাড়, কাঁধ ও বুক মোবারক:
তাঁর ঘাড় মোবারক অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহাবয়ব সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তাঁর ঘাড় মোবারক এত সুন্দর ও সূক্ষ্ম ছিল, যেমন কোনো ভাস্কর্যের গর্দান। (শামায়েলে তিরমিযী)।

হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত আছে, প্রিয় নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়স্কন্ধের হাড়সমূহ বড়সড় ছিল। (আর-রাহীকুল মাখতুম ৭৫২ পৃষ্ঠা)।

পেট মোবারক:
হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি পেট ও বক্ষের সমতল স্থুল দেহের অধিকারী ছিলেন। মেদভুড়ি সম্পন্ন ছিলেন না। (শামায়েলে তিরমিযী)।

এমনিভাবে উম্মে মা‘বাদ খাযাঈয়া (রা.) যিনি তার স্বামীর নিকট রাসূল (সা.) এর দৈহিক বিবরণ দিচ্ছিলেন, তিনি বলেন, তার মধ্যে মেদভুড়ির ত্রুটি ছিল না, বরং তাঁর দেহ মোবারক সারা জাহানের সৌন্দর্যের দীপ্তি ছড়ানো এক অপূর্ব ছবি ছিল। অর্থাৎ কোনো অপূর্ণতা ও ত্রুটি ছিল না যে, দেখতে অসুন্দর দেখাবে।

হস্ত মোবারক:
হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) এর হস্তদ্বয় প্রশস্ত, গোশতে পরিপূর্ণ ও নরম ছিল। হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (সা.) এর আঙ্গুলসমূহ একই ধরনের লম্বা ছিল। অর্থাৎ অন্য লোকদের তুলনায় একটু লম্বা ধরনের ছিল।

হ্যাঁ, তবে সীমাতিরিক্ত লম্বা ছিল না যে, অসুন্দর দেখা যায় এবং আঙ্গুলের জোড়া শক্ত ও বড় ছিল।  হজরত আলী ও হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) উভয়ের বর্ণনা যে, তার জোড়ার হাড় মোটাসোটা ছিল। (শামায়েলে তিরমিযী)।

দাড়ি ও গোঁফ:
দাড়ি রাখা প্রত্যেক নবীর সুন্নাত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও দাড়ি রাখতেন। মূলত তাঁর দাঁড়ি এত ঘন ছিল যে, পবিত্র বক্ষ ঢেকে যেত। (উসওয়ায়ে রাসূল, শা. তি.)।

গোঁফের ব্যাপারে বলতে গেলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোঁফ মোবারক কেটে খুব ছোট করে রাখতেন।

রাসূল (সা.) এর যুগে অগ্নিপূজকেরা গোঁফ লম্বা করে রাখত। আর দাড়ি খাটো করে রাখত। অথচ এটা ফিতরাত তথা নবীগণের অভ্যাস ও স্বভাব পরিপন্থী ছিল। এ জন্যই নবী (সা.) অগ্নিপূজকদের বিপরীত করার হুকুম দিলেন।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পশম ও চুল মোবারক:
মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কম বেশি সবার পশম থাকে, তবে রাসূল (সা.) এর কেমন ছিল সেটা আমাদের জানার বিষয়। সেটা জানার আগে তাঁর মাথা মোবারকের চুল সম্পর্কে খানিকটা জেনে নিই।

হজরত কাতাদাহ (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল মোবারক একেবারে সোজাও নয়, খুব বেশি কোঁকড়ানোও নয়।

হজরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল ঘন, কখনো কখনো কানের লতি পর্যন্ত লম্বা। কখনো ঘাড় পর্যন্ত।

হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী (সা.) এর দেহ মোবারকে স্বাভাবিকতার অধিক পশম ছিল না। কোনো কোনো লোকের দেহে প্রচুর পশম হয়ে থাকে।

রাসূল (সা.) এর দেহ মোবারকের কোনো কোনো অংশে পশম ছিল। আবার কোনো কোনো অংশ একেবারে পশমশূন্য ছিল। পবিত্র দেহের যে সকল স্থানে পশম ছিল, বিভিন্ন বর্ণনামতে সে স্থানসমূহ হলো-

বাহুদ্বয়।
উভয় পায়ের নলী।
উভয় স্কন্ধ।
বক্ষের উপরাংশ।
কণ্ঠনালী হতে নাভি পর্যন্ত একটি সূক্ষ্ম রেখার মত ছিল।
প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর বক্ষের উপরি অংশে পশমও ছিল। তবে উভয় স্তন পশম শূন্য ছিল। (শামায়েলে তিরমিযী)।

পা মোবারক:
হিন্দ ইবনে আবি হালা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) এর পায়ের তলা খানিকটা গর্ত ছিল। (শামায়েলে তিরমিযী)।

প্রিয় নবী (সা.) এর দেহাবয়বের বর্ণনায় আছে তাঁর পায়ের তলা খালি ছিল। (আর-রাহীকুল মাখতুম ৭৫২ পৃষ্ঠা)।

রাসূল (সা.) এর পায়ের আঙ্গুলসমূহ সমানভাবে অন্যদের তুলনায় একটু লম্বা ছিল। যেমনটা আঙ্গুলের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

চামড়া: রাসূল (সা.) এর শরীরের চামড়া রেশম থেকেও অধিক মসৃণ ও নরম ছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ. ৪৯, বিশ্বনবী পরিচয়-পৃ. ৭৮)।

ঘাম: রাসূল (সা.) এর শরীরে ঘাম হলে ঘামের বিন্দুগুলো মতির মতো চমকাত। তাঁর ঘাম ছিল অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত। (সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ. ৪৯, বিশ্বনবী পরিচয়-পৃ. ৭৮)।

মোহর: দুই কাঁধের মধ্যস্থলে কবুতরের ডিমসদৃশ একটু উঁচু মাংস খণ্ড ছিল। এটাই মোহরে নবুয়াত। এতে লিখা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ মোহরের ওপর তিলক ও পশম ছিল এবং রং ছিল ঈসৎ লাল। (সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ. ৪৯, বিশ্বনবী পরিচয়-পৃ. ৭৮)।

নিউজওয়ান২৪.কম/আরাফ