ঢাকা, ২৯ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ:

বদলি হজের বিধিবিধান

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৩০ জুলাই ২০১৯  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

হজরত আলী (রা.) এর সূত্রে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি এতটুকু সম্পদ ও সামর্থ্যরে মালিক হয় যা দ্বারা সে বাইতুল্লায় হজের জন্য যেতে পারে, কিন্তু তারপরও সে হজ করেনি তাহলে সে ইহুদী হয়ে মারা যাক বা খৃস্টান হয়ে তাতে কোনো সমস্যা নেই। 

এরপর রাসূল (সা.) এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘লোকদের মধ্য থেকে যারা বাইতুল্লায় যেতে সক্ষম তাদের ওপর হজ ফরজ।’ (সুনানে তিরমিজী)।

আরো পড়ুন>>>সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ, যা বলে ইসলাম... 

উলামায়ে কেরাম এই হাদিসের ব্যাখ্যায় নানা মত প্রকাশ করেছেন যে, রাসূল (সা.) উম্মতের প্রতি এত দরদী হওয়া সত্তেও কেন তিনি হজ ত্যাগকারীকে ইহুদী নাসারা হয়ে মৃত্যুর কথা বললেন। এ ব্যাপারে আল্লামা ইউসুফ বিন নূরী (রহ.) এর ব্যাখ্যাটি খুবই চমৎকার। তাই তার মতটিকে তুলে ধরা হলো। 

জেনে রাখা ভালো যে, হজের কার্যক্রমগুলো হচ্ছে হজরত ইব্রাহিম ও তার ছেলে ইসমাঈল (আ.)-কে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হজকে দ্বীনে ইব্রাহিমীর অনেক বড় প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর ইহুদী-নাসারারা দ্বীনের এই প্রতীকের খুবই বিরোধিতা করে (কারণ, হজের কার্যক্রম হজরত ইসমাঈল (আ.)-কে কেন্দ্র করে, যাকে ওরা নিজেদের বংশের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে)। তো মুসলমানের পরিচয় যেমন নামাজ পড়া না পড়ার মাধ্যমে পাওয়া যায় তেমনি হজের মাধ্যমেও পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন>>> হজে বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় মিলবে ‘৯১১’-এর জরুরি সেবা

মুসলমান ও মুশরিক সম্প্রদায়ের মাঝে যেমন পার্থক্য হচ্ছে নামাজ। তেমনি ইহুদী-নাসারা ও মুসলমানের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে হজ। অতএব, যে নাকি সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ করবে না বাহ্যিকভাবে তার মাঝে ও ইহুদিদের মাঝে কোনো পার্থক্য রইলো না। তাই নবী করিম (সা.) এই কথা বলেছেন। (মাআরেফুস সুনান, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৫) এর দ্বারা মূলত হজের বিধান কতটুকু গুরুত্বের দাবী রাখে তা বুঝা যায়। তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে, যখনই হজ ফরজ হবে তাৎক্ষণিক তা আদায় করে ফেলা। কিন্তু কোনো কারণে যদি বিলম্ব হয়েই যায় যে, তার পক্ষে হজ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না তাহলে করণীয় হচ্ছে, বদলি হজের ব্যাপারে ওসিয়ত করে যাওয়া। যদি ওসিয়ত নাও করে যায় তারপরও আত্মীয়-স্বজনরা তার পক্ষ থেকে আদায় করে তাহলে তা উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হবে ইনশাআল্লাহ! বদলি হজের ব্যাপারে হাদিসও বর্ণিত হয়েছে।

অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলি হজ আদায় করা: 
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) ফজল ইবনে আব্বাসের সূত্রে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এক মহিলা নবী করীম (সা.) এর নিকট এসে বলেন, আমার পিতা খুবই বৃদ্ধ মানুষ। তিনি বাহনের ওপর বসে থাকতে সক্ষম নন। তখন রাসূল (সা.) ওই মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ কর। (তিরমিজী)।

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলি হজ করা:
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুরাইদা স্বীয় পিতা বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার এক মহিলা রাসূল (সা.) এর নিকট এসে বলেন, আমার মা মারা গেছেন, কিন্তু তিনি হজ আদায় করে যেতে পারেননি, আমি কী তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করবো? রাসূল (সা.) বলেন হ্যাঁ, তার পক্ষ থেকে তুমি হজ আদায় কর। (তিরমিজী)। ইমাম তিরমিজী (রাহ.) এই হাদিসটি হাসান ও সহীহ বলেছেন, যা অনুযায়ী আমল করতে কোনো সমস্যা নেই। উভয় হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে কনো সমস্যা নেই। ইনশাআল্লাহ! এর দ্বারা মৃত ব্যক্তি হজের জিম্মাদারি থেকে মুক্তি পাবে।

বদলি হজের বিধিবিধান-

বদলি হজকারী হজে তামাত্তুর ইহরাম বাঁধা:
আমরা বিভিন্ন আলোচনায় শুনেছি হজ তিন প্রকার। বদলি হজ আদায়কারী ব্যক্তি হজে কিরান বা হজে ইফরাদের নিয়ত করবে। হজে তামাত্তুর নিয়ত করবে না। তবে যার হজ আদায় করা হচ্ছে তার পক্ষ থেকে যদি তামাত্তু হজ আদায়ের অনুমতি থাকে তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তবে এক্ষেত্রে কোরবানি হজ আদায়কারীর পক্ষ থেকে দিতে হবে। আর যদি মূল ব্যক্তি অনুমতি না দেয় আর বদলি হজকারী তা সত্তেও তামাততু আদায় করে তাহলে হজই আদায় হবে না। সে ক্ষেত্রে হজ আদায়কারীর দায়িত্ব হবে সমস্ত খরচ মূল ব্যক্তিকে ফেরত দেয়া। এ জন্য উলামায়ে কেরামের পরামর্শ হচ্ছে, সব প্রকার হজ আদায়ের অনুমতি দিয়ে দেয়া। (ফতোয়ায়ে উসমানি, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২২২)। কোনো কোনো আলেমের মতে বদলি হজের ক্ষেত্রে তামাততু আদায় করা হলে হজই আদায় হবে না। তবে প্রথম মতটিকেই উলামায়ে কেরাম সহীহ বলেছেন।

যে নিজে হজ করেনি তার দ্বারা বদলি হজ করানো: 
যে ব্যক্তি নিজের হজ আদায় করেনি তার দ্বারা বদলি হজ করালে হানাফি মাজহাব মতে আদায় হয়ে যাবে। তবে যে বদলি হজ করছে তার ওপরও যদি হজ ফরজ থাকে তাহলে তার জন্য অন্যের বদলি হজ করা মাকরূহে তাহরিমী ও যে আদায় করাচ্ছে তার জন্য এমন ব্যক্তি দ্বারা বদলি হজ করানো মাকরূহে তানযিহী। আর যদি ওই ব্যক্তির ওপর ফরজ না হয়ে থাকে তাহলে উভয়ের জন্য মাকরূহে তানযিহী। তাই উত্তম হচ্ছে, বদলি হজের জন্য এমন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা যে নিজের ফরজ হজ আদায় করেছে। (ফতোয়ায়ে উসমানি, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২১৬ ও কিতাবুল ফাতাওয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৫৯)।

যার ওপর হজ ফরজ হয়নি অন্যের বদলি হজ আদায় করার দ্বারা তার ওপর হজ ফরজ হবে না:
যার ওপর হজ ফরজ নয় সে অন্যের বদলি হজ আদায় করলে তার ওপরও কী হজ ফরজ হয়ে যাবে? এ ব্যাপারে দুটি মতই পাওয়া যায়। যেমন মাজমাউল আনহুর নামক কিতাবের লেখক, মোল্লা আলী ক্বারী ও সায়্যেদ আহমদ বাদশা (রাহ.) প্রমুখের মতে অন্যের বদলি হজ করার দ্বারা ওই ব্যক্তির ওপরও হজ ফরজ হয়ে যাবে। আর অধিকাংশ আলেমগণের মত হচ্ছে, শুধু অন্যের বদলি হজ করার দ্বারা কারো ওপর হজ ফরজ হবে না। এই মতটিকে প্রসিদ্ধ ফকিহ আল্লামা ইবনে আবেদিন শামী (রাহ.) প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই এখন ফতোয়া এটাই যে, তার ওপর হজ ফরজ হবে না। (ফতোয়ায়ে উসমানি, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২১৬)।

বদলি হজ আদায়কারীর পক্ষ থেকে কারো মেহমানদারী করানো:
বদলি হজ আদায়ের সময় মূল ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার মাল থেকে দান সদকা করা বা কারো মেহমানদারী করা না জায়েয। এ জন্য উচিত হচ্ছে, মূল ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাপক অনুমতি নিয়ে নেয়া যেন রাস্তায় কনো কষ্টের সম্মুখীন হতে না হয়। (মুআল্লিমুল হুজ্জাজ-৩৭৬)। বদলি হজ যেহেতু অন্যের খরচে হয়ে থাকে তাই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমানতদারীর পরিচয় দেয়া চাই। অনেকের ক্ষেত্রে এমন দেখা যায় যে, নিজের অর্থে ওই কাজ করা হলে অনেক খরচ বাঁচিয়ে কাজটা করা হতো, কিন্তু অন্যের খরচে হওয়ার দরুণ এ ব্যাপারে কোনো পরোয়াই করা হয় না, এটা অনুচিত। অন্যের অর্থ ব্যয়েও ওই পন্থা অবলম্বন করা উচিত যেমনটা নিজের বেলায় করা হয়। 

ইজারা বা ঠিকাদারীর ভিত্তিতে বদলি হজ করা:
ইজারা বা ঠিকাদারীর ভিত্তিতে বদলি হজ করা জায়েয নেই। কারণ, হজ হচ্ছে ইবাদত। আর ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ করা না জায়েয। তবে হজের খরচ মূল ব্যক্তিকেই বহন করতে হবে এবং  আদায়কারী দরিদ্র হলে হজ থেকে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তার পরিবারের ভরণ পোষণও তাকে বহন করতে হবে। (কিতাবুল ফাতাওয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৬৭)। বর্তমানে হজের ব্যাপারে কিছু অসাধু লোক নানা অসৎ সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। হজ আল্লাহ তায়ালার বিশেষ বিধান। হজের মাকাম হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাবান স্থান। যেখানে সর্বদা আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি নিবদ্ধ। তাই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। 

বদলি হজ জায়েয হওয়ার শর্তসমূহ:
(এক) যার পক্ষ থেকে বদলি হজ করা হচ্ছে তার ওপর হজ ফরজ হওয়া। কেউ যদি হজ ফরজ হওয়ার আগেই বদলি হজ করিয়ে ফেলে তারপর ওই ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ হয় তাহলে পুনরায় তাকে হজ আদায় করতে হবে। প্রথম হজ নফল হিসেবে গণ্য হবে, ফরজ হিসেবে আদায় হবে না।

(দুই) হজ ফরজ হওয়ার পর দারিদ্রতা বা অসুস্থতার কারণে হজ আদায় করতে অক্ষম হওয়ার পর অন্যের দ্বারা বদলি হজ করানো। অক্ষম হওয়ার আগেই বদলি হজ করিয়ে ফেললে তারপর অক্ষম হলে পুনরায় হজ করাতে হবে। পূর্বের হজ যথেষ্ট হবে না।

(তিন) যে সকল শরয়ী ওজরের কারণে বদলি হজ করানো জায়েয ওই ওজরগুলো মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকা। আগে বদলি হজ করিয়ে ফেললে পরে সুস্থ হয়ে গেলে পুনরায় হজ করা তার ওপর ফরজ হয়ে যাবে।

(চার) হজের খরচ মূল ব্যক্তিকে বহন করা। যে অন্যের বদলি হজ করছে, সে খরচ বহন করলে হজ তার পক্ষ থেকে আদায় হবে নির্দেশদাতার পক্ষ থেকে আদায় হবে না। তবে অধিকাংশ খরচ যদি নির্দেশদাতা আর আংশিক কিছু হজকারী বহন করে তাহলে মূল ব্যক্তির পক্ষ থেকেই হজ আদায় হবে।

(পাঁচ) নির্দেশদাতার পক্ষ থেকে হজ আদায়ের নিয়ত করা।

(ছয়) একজনের পক্ষ থেকে বদলি হজের নিয়ত করা। এক ব্যক্তি দুজনের বদলি হজের নিয়ত করলে কারো পক্ষ থেকে হজ আদায় হবে না।

এ রকম আরো কিছু শর্ত রয়েছে যেগুলো উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমাদের বদলি হজ করা উচিত। 

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা আমাদের কোরআন-হাদিসের আলোকে বদলি হজের  গুরুত্ব ও বিধিবিধান জানার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

নিউজওয়ান২৪.কম/আহনাফ