ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

পবিত্র হজ কী এবং কেন?

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:৩২, ১৫ জুলাই ২০১৯  

পবিত্র মক্কা শরিফ (ফাইল ফটো)

পবিত্র মক্কা শরিফ (ফাইল ফটো)

শুরু হয়েছে হজের মওসুম। মিম্বরে মিম্বরে হজের আলোচনা। চারদিকে সাজ সাজ রব। কারো মুখে তালবিয়া, কারো মনে আগামীর স্বপ্ন, আর কারো হৃদয় জুড়ে মক্কা-মদীনার স্মৃতি ও হাহাকার।

এভাবেই হজের মওসুম আসে আর গোটা মুসলিম জাহানের হৃদয় ও আত্মাকে মথিত আলোড়িত করে যায়। যতদিন থাকবে মুমিনের দেহে এক বিন্দু প্রাণ, থাকবে উম্মাহর হৃদয়ে কিছুমাত্র ঈমানের স্পন্দন ততদিন মক্কা-মদীনা, মীনা-আরাফা আমাদের আলোড়িত করবেই। 

হজ পরম করুণাময় মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর তায়ালার ইবাদত। বান্দার প্রতি স্রষ্টার হক। ঈমানের আলোকিত নিদর্শন। 

পবিত্র কোরআন মজীদের ইরশাদ হয়েছে,

وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا ؕ وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الْعٰلَمِیْنَ

‘মানুষের ওপর আল্লাহর বিধান ওই ঘরের হজ করা, যার আছে সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য। আর কেউ কুফর করলে আল্লাহ তো বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭)।

সুতরাং হজ আল্লাহর বিধান, আল্লাহর হক।

মেহেরবান আল্লাহ এ বিধান কত সহজ করে দিয়েছেন! শুধু সামর্থ্যবানদের জন্য তা ফরজ। এরপর সারা জীবনে একবারমাত্র করা। বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الحج مرة فمن زاد فهو تطوع

‘হজ একবার। এরপর যে বেশি করে তা ঐচ্ছিক।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১২০৪)।

সুতরাং সামর্থ্য থাকার পরও যে হজ করে না কে আছে তার মতো বদ নসীব?

উপরের আয়াতের وَ مَنْ كَفَرَ ‘আর কেউ কুফর করলে…’কথাটি অতি ভয়াবহ। এতে এই ইঙ্গিতও আছে যে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করা একপ্রকারের কুফর। কর্মগত কুফর তো বটেই, কারণ হজ ইসলামের একটি রোকন। সুতরাং বিনা ওজরে তা পালন না করা কুফরের এক শাখা। নেক আমলগুলো যেমনি ঈমানের শাখা তেমনি বদ আমল ও গুনাহের কাজগুলো কুফরের শাখা। আর কুফরের শাখা-প্রশাখায় বিচরণকারীর ঈমান যে ঝুঁকিগ্রস্ত তা তো বলা অপেক্ষা রাখে না।

হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত,

مَنْ أَطَاقَ الْحَجَّ وَلَمْ يَحُجَّ حَتَّى مَاتَ فَسواء عَلَيْهِ أَنَّهُ مَاتَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا

‘হজের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে হজ করল না, এরপর সে ইহুদি অবস্থায় মারা যাক কী নাসরানী অবস্থায় সবই তার জন্য সমান!’ (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮)।

হজ একটি ইবাদত এবং হজের সফর একটি ইবাদতের সফর। এ নিছক ভ্রমণ বা পর্যটন নয়। ইসলামে তো ভ্রমণ-পর্যটনেরও রয়েছে আলাদা নীতি ও বিধান, যা রক্ষা করা ও পালন করা কর্তব্য। সুতরাং ইবাদতের সফরে আদব রক্ষা করা এবং প্রচলিত ভ্রমণ-পর্যটনের স্বেচ্ছাচার থেকে পবিত্র রাখা তো অতি জরুরি। এরপর যে সময়টুকু ইহরামের হালতে থাকা হয় ওই সময়ের জন্য তো বিশেষ কোরআনী নির্দেশ,

فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوْقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الْحَجِّ

‘হজে কামাচার, পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদের অবকাশ নেই।’(সূরা বাকারা (২) : ১৯৭)।

আর এ নির্দেশ পালনের প্রতিদান কী তা সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ,

مَنْ حَجَّ لله فَلَمْ يَرْفُثْ، وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ

‘যে আল্লাহর জন্য হজ করল অত:পর তাতে অশ্লীল কর্ম ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল সে ওই দিনের মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায় যেদিন সে ভূমিষ্ট হয়েছিল।’ (সহীহ বুখারী, হাদিস ১৫২১; সহীহ মুসলিম, হাদিস ১৩৫০)।

অন্য হাদিসে বলেছেন,

الْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّة

মাবরূর হজের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।’ (সহীহ বুখারী, হাদিস ১৭৭৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৩৪৯)।

মাবরূর হজ ওই হজ যা শরীয়তের নিয়ম মোতাবেক গুনাহ থেকে বেঁচে আদায় করা হয়।

হজ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাহ। এই দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে ইসলামের ইবাদত অন্য সকল ধর্মের ইবাদত-উপাসনা থেকে আলাদা। ইবাদত একমাত্র আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা এবং যাঁর ইচ্ছায় সৃজন-বর্ধন, লয়-ক্ষয়, উপকার-অপকার। তিনিই একমাত্র উপাস্য ও মাবুদ। তিনি ছাড়া ইবাদত-উপাসনার উপযুক্ত আর কেউ নেই। এই তাওহীদই হচ্ছে জগত-স্রষ্টার শাশ্বত বিধান। এই বিধান দিয়েই তিনি যুগে যুগে নবী রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন।

وَ لَقَدْ بَعَثْنَا فِیْ كُلِّ اُمَّةٍ رَّسُوْلًا اَنِ اعْبُدُوا اللّٰهَ وَ اجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ

‘আমি তো প্রত্যেক জাতির মাঝেই রাসূল পাঠিয়েছি (এ পয়গাম দিয়ে যে,) তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগূতকে বর্জন কর।’ (সূরা নাহল (১৬) : ৩৬)।

وَ مَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا نُوْحِیْۤ اِلَیْهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعْبُدُوْنِ

‘আপনার আগে আমি যে রাসূলই পাঠিয়েছি তাঁর প্রতি এই ওহী করেছি যে, আমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। সুতরাং আমার ইবাদত কর।’ (সূরা আম্বিয়া (২১) : ২৫)।

সর্বশেষে আখেরী নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও এ বিধান দিয়েই পাঠানো হয়েছে এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে।

قُلْ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللّٰهِ اِلَیْكُمْ جَمِیْعَا ِ۟الَّذِیْ لَهٗ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ یُحْیٖ وَ یُمِیْتُ ۪ فَاٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهِ النَّبِیِّ الْاُمِّیِّ الَّذِیْ یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ كَلِمٰتِهٖ وَ اتَّبِعُوْهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ

‘বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান। সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যিনি ঈমান আনেন আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে এবং তাঁর অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সঠিক পথ পাও।’ (সূরা আরাফ (৭) : ১৫৮)।

সুতরাং‘তাওহীদ’ও‘ইত্তিবায়ে রাসূল’ এ দুই হচ্ছে আসমানী দ্বীন তথা স্রষ্টাকর্তৃক প্রেরিত ধর্মের প্রাণসত্তা এবং স্রষ্টার ইবাদত-উপাসনা ও সকল ধর্ম-কর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

সূরা মুলকের বিখ্যাত আয়াত-

الَّذِیْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَ الْحَیٰوةَ لِیَبْلُوَكُمْ اَیُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا

‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।’ (সূরা মুলক (৬৭) : ২)।

পরম করুণাময় চান ‘উত্তম’কর্ম; অধিক কর্ম নয়। আর উত্তম কর্ম তা-ই যা তাঁর প্রেরিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক সম্পন্ন হয়। মনগড়া পদ্ধতির ধর্ম-কর্ম তা পরিমাণে যতই হোক এবং যতই ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ হোক আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

শিরকের এক প্রকার শিরকে আসগর বা ছোট শিরক। ‘রিয়া’বা লোক দেখানো ধর্ম-কর্ম এই শিরক-পরিবারেরই সদস্য। হজের মতো ইবাদতে রিয়ার মিশ্রণ ঘটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। কাজেই হজের আগে নিয়ত খালিস করে নেয়া কর্তব্য।

হজের মূল্যবান সময় অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় না করে ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনী ইলম অর্জনে মশগুল থাকা কর্তব্য। এভাবে আমাদের হজ, যা এক মহান ইবাদত ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রোকন, সুসম্পন্ন হওয়ার আশা করা যায়।

পরম করুণাময় মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফীক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।

নিউজওযান২৪.কম/আহনাফ