ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

দিল্লিতে বাংলাদেশি বিরিয়ানির জয়গান

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১২:৪৯, ৬ এপ্রিল ২০১৯  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

সাদা দাড়িতে বাঁ হাতের আঙুল বোলানো ও ডান হাতে ধরা ছড়িটা দিয়ে সবুজ লনে প্রত্যয়ের ঠোকা মারা প্রায় একসঙ্গেই হলো। সেই সঙ্গে শোনা গেল হাজি সাহেবের স্বর, ‘ইনশা আল্লাহ, কলকাতা ও দিল্লি প্রায় একসঙ্গেই হয়ে যাবে।’

ভূমিকা না জানলে একসঙ্গে কলকাতা ও দিল্লিতে হবেটা কী, কবে হবে, কেন হবে ইত্যাদি প্রশ্ন ও তার উত্তর বোঝা এককথায় অসম্ভব। তার ওপর যদি না জানা থাকে হাজি সাহেবের পরিচয়। অতএব, মুখবন্ধের সেই প্রাথমিক ও প্রারম্ভিক কাজটা আগে সেরে ফেলা যাক।

হাজি সাহেবের পুরো নাম মোহাম্মদ রফিক। কিন্তু এটুকুই সব নয়। ত্রিভুবনে মোহাম্মদ রফিক আছেন হাজারে হাজারে। অথবা লাখে লাখে। কিন্তু যদি বলা হয় এই হাজি সাহেব ঢাকার ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ছেলে, ব্যস, আর কোনো সংশয় তা হলে থাকবে না। বাংলাদেশে ফখরুদ্দিন বাবুর্চির পরিচয় এমনই যে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি-রোনালদো-বচ্চনের নাম লেখা ঠিকানাবিহীন চিঠির মতো তাঁকে লেখা পোস্টকার্ডও ঠিক নিজ নিকেতনে পৌঁছে যাবে।

এ এক নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ও আটপৌরে মানুষের জীবনকাহিনি, ঢাকার ভিকারুননিসা স্কুলের কেয়ারটেকারের দায়িত্ব নিয়ে যাঁর জীবন শুরু, যিনি সেই স্কুলে ক্যানটিন খোলার অনুমতি পেয়ে শিঙাড়া-নিমকি ভাজতে ভাজতে একদিন কাচ্চি বিরিয়ানির মুকুটহীন বাদশাহ সেজে যান। কাচ্চি বিরিয়ানি দিয়ে রসনা তৃপ্তির এভারেস্টেই শুধু ফখরুদ্দিন আরোহণ করেননি, মৃত্যুর পরেও যাতে তাঁর সাম্রাজ্য 
অটল থাকে, সেই ব্যবস্থাও করে গেছেন।

হাজি মোহাম্মদ রফিক তাই গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন, ‘আল্লাহর কৃপায় আমাদের বাবা ছয় ছেলের জনক। দুই ভাই আজ আর নেই। কিন্তু ফখরুদ্দিনের কাচ্চি বিরিয়ানির ধ্বজা উড়ছে তো উড়ছেই। ভবিষ্যতেও এমনই পতপত করে উড়বে ইনশা আল্লাহ।’

রাজধানী দিল্লির বিরিয়ানি-প্রিয় মানুষজনকে হ্যাংলা করে তোলার দায়দায়িত্ব বা কৃতিত্ব যতটা বাংলাদেশ হাইকমিশনের, ততটাই ফখরুদ্দিন বাবুর্চির। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ফখরুদ্দিনকে দিল্লি এনে হাইকমিশন সেই কাজটা করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক শিল্পমেলা হোক, দেশের স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসের উদ্‌যাপন অথবা কারও কোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ফখরুদ্দিনের কাচ্চি বিরিয়ানির উপস্থিতি হয়ে উঠেছে সমার্থক।

গত ২৬ মার্চ, বাংলাদেশ ভবন ও হাইকমিশন চত্বর স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় ঝলমল করে ওঠার পাশাপাশি বিরিয়ানির গন্ধে আরেও একবার ম ম করে ওঠে। দেশ-বিদেশের হাজার মানুষের রসনা তৃপ্ত করে মোহাম্মদ রফিক হাসিমুখে বলেন, ‘উদর ভরিয়ে মানুষের হৃদয় জেতার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই।’ ফখরুদ্দিনের সিনিয়র ম্যানেজার আবদুর রাজ্জাক নির্মল হেসে বলে ওঠেন, ‘আমাদের আনন্দ তখন দ্বিগুণ হয়, যখন দেখি মানুষজন আমাদের কাছে কাচ্চি বিরিয়ানির রেসিপি জানতে চাইছেন। অথচ আমাদের গোপন করার মতো কিছুই নেই।’

এটা ঠিক, কাচ্চি বিরিয়ানি তৈরির যাবতীয় কারিকুরি ফখরুদ্দিন বাবুর্চি ও ইউটিউবের কল্যাণে আজ সর্বজনীন। কিন্তু তবু জনপ্রিয় ধারণা, কিছু একটা তুরুপের তাস নিশ্চয় রয়েছে, যা গোপন এবং যা ফখরুদ্দিনকে অন্যদের চেয়ে অনন্য করে তুলেছে। কথাটা পাড়ামাত্র হাজি রফিক, তাঁর পুত্র ও এই সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল খালেক কিংবা আবদুর রাজ্জাকদের মুখে স্মিত হাসির একটা ঢেউ খেলে যায়। গোপন কিছুই নেই জানিয়েও গোপন কথা বলার ঢংয়ে নিচু স্বরে তাঁরা বলেন, ‘পরিমাণটাই আসল কথা। মাল-মসলার পরিমাণের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশেলই সাফল্য।’

সেই সাফল্যের ঢেউ এমনই যে দিল্লিতে কবে ফখরুদ্দিন থিতু হবে, সেই প্রশ্ন জাতীয় দিবসের সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ভবনের সবুজ লনে নতুন করে ভাসতে থাকে। সিডনি, সিঙ্গাপুর, দুবাই, লন্ডনে ফখরুদ্দিন যদি ঘাঁটি গাড়তে পারে, তবে কেন দিল্লি নয়? অথবা কলকাতা?

হাজি সাহেব সামান্য সময় চুপ করে থাকেন। তারপর যা কবুল করেন, সেই সত্য উপেক্ষা বা অস্বীকার করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। শিখিয়ে পড়িয়ে যাঁদের তিনি বিদেশে নিয়ে গিয়ে ফখরুদ্দিনের সাম্রাজ্য বিস্তারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ বাঁধন কেটে নিজেদের স্বাধীন করে ফেলেছেন। মানব চরিত্রের পরিবর্তনের এই বাঁক বোঝা শুধু কঠিনই নয়, কষ্টেরও।

হাজি সাহেব অবশ্য হাল ছাড়েননি। শেফ হিসেবে যাঁদের পাঠাবেন, তাঁদের কাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ভিসার প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় সেই অনুমতিটুকু পাওয়া গেলে কলকাতা ও দিল্লিতে ঘাঁটি তাঁরা গাড়তে চান। কিন্তু ফের যদি মন ঘুরে যায়? স্বাধীন হওয়ার তাগিদ মাথাচাড়া দেয়? সে ব্যবস্থা পাকা করেই হাজি সাহেব আসরে নামতে চাইছেন। বারবার একই ভুল কে-ই বা করতে চায়?

কাচ্চি বিরিয়ানি, জালি কাবাব, কোর্মা বা ফখরুদ্দিনের ‘সিগনেচার ডিশ’-এর আগাম স্থায়ী আগমনের অভিনন্দন জানানো শেষ হয়েছে কি হয়নি, সাদা দাড়িতে বাঁ হাতের আঙুল বুলিয়ে ও ডান হাতে ধরে থাকা লাঠি সবুজ লনে ঠুকে হাজি মোহাম্মদ রফিক বললেন, ‘পুরোনো ভুল আর নতুনভাবে করব না। আটঘাট বেঁধেই এবার নামব। ইনশা আল্লাহ, কলকাতা ও দিল্লি একসঙ্গেই হয়ে যাবে।’
 

প্রবাসী দুনিয়া বিভাগের সর্বাধিক পঠিত