ঢাকা, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

দরুদ ও সালাম প্রিয়নবী (সা.)...

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৬:১১, ১৩ নভেম্বর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

 

মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্যই সকল প্রশংসা। যিনি মানব জাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন।

এ ধারাবাহিকতায় শেষ নবী হিসাবে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে তাঁর অনুকরণের মাধ্যমে তাকে ভালোবাসার নির্দেশ দিয়েছেন। দরুদ ও সালাম প্রেরণ করছি মানবতার মুক্তির দূত, রহমাতুল্লিল আলামীনের প্রতি, যার আনুগত্য ও ভালোবাসা মহান আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের মাধ্যম।

শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক সকল সাহাবায়ে কেরামের প্রতি, যারা ছিলেন রাসূল (সা.) এর ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় এবং সকল তাবেয়ীন ও তাবে’তাবেয়ীনসহ কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলিম উম্মাহর প্রতি।

হিজরি বছরের চাকা ঘুরে আবার আমাদের মাঝে উপস্থিত এখন রবিউল আওয়াল মাস। ইসলামি ইতিহাসে রবিউল আওয়াল গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি মাস। ঐতিহাসিক মাস। রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ আকাশে উঁকি দিতেই বিশ্বময় মুসলমানদের মাঝে নতুন করে এক আন্দোলন শুরু হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুহাব্বত নতুন করে জাগ্রত হয়।

কারণ, অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এ মাসে সাইয়েদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন খাতামুন নাবীয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, পবিত্র মক্কা থেকে মদীনা মুনাওয়ারা হিজরত করেন এ মাসে, আবার এ মাসেই তিনি মহান আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত রিসালাতের সকল দায়িত্ব পালন শেষে স্বীয় প্রভুর আহবানে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন।

যখনই এ মাসের শুভাগমন হয়, মুসলমানদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে নবী-প্রেমের নতুন হাওয়া জাগে, তারা নতুন করে আন্দোলিত হয়। মনের অজান্তেই নবী পাগল মন গেয়ে উঠে-

‘বালাগাল উলা বি-কামালিহি/কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহি/হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি/সাল্লু আলায়হে ওয়া আলিহি।’ নবী (সা.) এর প্রেমে রচিত এ কবিতা মুমিনের হৃদয়ে ছন্দের মতো বেঁজে উঠে। তখন নবীপ্রেমে উতলা হয় মন। ভালোবাসার সবকিছু ঢেলে উচ্চারণ করি ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’।

যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মাঝে অনেক মতভেদ রয়েছে, যথাক্রমে : ১২, ৯, ৮ রবিউল আওয়াল। কিন্তু এ মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন, এ বিষয়ে কোনো মতানৈক্য নেই। (আস সীরাতুন নববিয়া লিমুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব: ১৫৯,আল্লামা ইদ্রিস কান্দলভী: সীরাতে মুস্তাফা খণ্ড: ১)

মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা ও তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা ঈমানের অংশ। নবী (সা.)-কে অস্বীকারকারী জান্নাতের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। এ কারণে ঈমানের পূর্ণাঙ্গতা পেতে হলে নবী (সা.)-কে বিশ্বাস ও ভালোবাসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (রহ.) তার কিতাবে স্বতন্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন, যার অর্থ ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ।’ বিশিষ্ট সাহাবী আনাস (রা.) ও হজরত আবূহুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ হতে প্রিয় না হবো।’ (বুখারী শরীফ: হা: ১৫, মুসলিম শরীফ: হা: ৪৫, মুসনাদে আহমদ: ১২৪৩)

পবিত্র কোরআনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবী! আপনি বলুন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমদের সন্তান, তোমাদের ভাই-বোন, তোমদের পত্নি, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা কর- আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সূরা তাওবা: ২৪)

উল্লিখিত আয়াতে গোটা মুসলিম জাতির প্রতি এ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারো ভালোবাসা স্থান পাবে না। তাই যার ভালোবাসা এ স্তরে নেই সে শাস্তির যোগ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার অর্থ রাসূল (সা.) এর সীরাত আলোচনা করা যেমন পূণ্যের কাজ তেমনি ভাবে তার সূরত বা দৈহিক গঠন নিয়ে আলোচনা করাও পূণ্যের কাজ।

কিন্তু দৈহিক সূরত নিয়ে আলোচনার মাঝে আমাদের করণীয় কিছু নেই। শুধু আলোচনার দ্বারা সাওয়াব পাওয়া যায়। কারণ শত চেষ্টা করেও আমাদের সূরতকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সূরতের ন্যায় করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তাঁর সীরাত নিয়ে আলোচনার দ্বারা সাওয়াব পাওয়াব পাশাপাশি অনুরুপ চরিত্র গঠনের আশা করা যায়, যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি।

অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের মুসলিম সমাজের কতিপয় লোক ভালোবাসার নামে রাসূল (সা.) এর জীবনাদর্শ ও সুন্নাতকে বাদ দিয়ে রবিউল আউয়াল মাস এলে ঈদে মীলাদুন্নবী ও জসনে জুলুসের নামে নারী-পুরুষ সম্মিলিত বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আনন্দ মিছিল ও শোভা যাত্রার মধ্য দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিনকে শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করাকে ইবাদত মনে করেন। বস্তুত এসব কার্যাবলী অমুলক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যার কোনো শরয়ী ভিত্তি নেই।

একটু চিন্তু করলে দেখা যায়, রবিউল আওয়াল মাসের এ দিনটিতে রাসূল (সা.) জন্মের ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে, কিন্তু এ দিনটিতে তার ইন্তেকালের ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। তাহলে আমরা এ দিনটিতে আনন্দ উৎসব পালন করি কিসের ভিত্তিতে? বরং সত্যিকারার্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসার অর্থ হলো, তিনি যে সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং যে সকল বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা।

এ মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনীত দ্বীনকে তোমরা আকড়ে ধর, আর যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর।’ (আল হাশর: ৭)

রাসূল (সা.) এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসেঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (আল আহযাব: ২১)

পবিত্র কোরআন ও হাদীসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে আমল করেছেন বা করতে বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেয়ার নামই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করাকে শরীয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসার ব্যাপারে তিনি যেভাবে ভারোবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালোবাসাই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করা শরীয়ত সমর্থন করে না।

পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপার নিষেধও করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘খ্রীষ্টানরা যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারয়ামের (আ.) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা তেমনিভাবে আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, অতএব তোমরা বল আল্লাহর বান্দ এবং তাঁর রসূল।’

এখানে বাড়াবাড়ি করার অর্থ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যাবলীর ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করা। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাযির-নাযির বলা, তিনি নূরের তৈরি, তিনি গায়েব জানেন, তার নামে কসম খাওয়া, তাঁর নামে মান্নত করা, তাঁর নিকট দোয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা আল্লাহর গুণ সমূহে গুণান্বিত করা ইত্যাদি। এ ধরনের কার্যকলাপ শরীয়তে গর্হিত। তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।

অপরদিকে মুসলিম উম্মাহর কাছে এ মাস সীমাহীন আনন্দের মাস, আবার এ মাসেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন বিধায় মুসলিম জাতির নিকট এ মাসটি সীমাহীন দুঃখের মাস। যার ফলে মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমন দিবস ও ওফাত দিবসে তাঁর ভালোবাসার চেতনাবোধে নিজেদেরকে উজ্জীবিত করে। রাসূলপ্রেমে হয়ে ওঠে আত্মহারা পাগলপারা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসায় মিলাদ, কিয়াম, জশনে-জুলুশসহ সর্বপ্রকার অনুষ্ঠানেকোনো বাঁধা নেই। তবে শুধুমাত্র অনুষ্ঠানসর্বস্ব রবিউল আউয়াল আমরা যতই উদযাপন করি, প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা থেকেই যাবে, যদি না আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য না করি।

রাসূল (সা.) এর প্রতি প্রেম বা ভালোবাসা তখনই পরিপূর্ণতা লাভ করবে, যখন তাঁর ওপর নাজিলকৃত পবিত্র কোরআন ও তাঁর রেখে যাওয়া সুন্নাহ মোতাবেক মানুষ জীবন-যাপন করবো।

অতএব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মরণে শুধুমাত্র অনুষ্ঠান উদযাপনে সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং প্রতিটি মানুষের বাস্তব জীবনকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের রঙে রাঙিয়ে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদেরকে তৈরি করাই হোক এ মাস উদযাপনের দাবি।

মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ঈদে মিলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবী পালনের মাধ্যমে প্রকৃত রাসূল (সা.) এর প্রেমিক ও আল্লাহ ওয়ালা হওয়ার তাওফিক দান করুন। সবশেষে মুবারকবাদ জানাই এ মাসকে এবং নিরলস কাজের কামনা করি এ মাসের মর্যাদাকে সমুন্নত করতে। আপনাকে আবারও সালাম জানাই হে নবী (সা.)। আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন!

নিউজওয়ান২৪/আরএডব্লিউ