ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

‘গীবত’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৩৪, ৭ নভেম্বর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

 

আরবি শব্দ غِيبَةُ (গীবাতুন) থেকে গীবত। গীবত এর অর্থ হলো কুৎসা রটনো, দোষ বর্ণনা করা, সমালোচনা করা, পরনিন্দা করা ইত্যাদি।

গীবতের পারিভাষিক সংজ্ঞাটা স্বয়ং রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই দিয়েছে। তিনি বলেন,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْغِيبَةُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ. قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِى أَخِى مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدْ بَهَتَّهُ

অর্থ : হজরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে রাসূলাল্লাহ! গীবত কি বিষয়? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- গীবত হলো তোমার অনুপস্থিত ভাইয়ের এমন কিছু বর্ণনা করা যা সে অপছন্দ করে (বা শুনলে সে কষ্ট পাবে) তখন বলা হলো যদি বলা দোষগুলো তার মাঝে থাকে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ বললেন, যদি থাকে তাহলেই গীবত হবে, অন্যথায় সে মিথ্যা বললো বা অপবাদ দিলো’ (সুনানে আবু দাউদ খ- ০৪, পৃষ্ঠা ৪২০।)

গীবত কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যেকোনো বিষয়ে গীবত হতে পারে। এমন বিষয় হলেই গীবত হবে যা শুনলে সে কষ্ট পায়। ইলম কালাম, জ্ঞান গরিমা, অর্থ সম্পদ, আমল আখলাক, বৃদ্ধি বিবেক, পোশাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, উঠাবসা, বংশ খান্দান, শারীরিক গঠন ইত্যাদি। কারো মুখের জড়তা, অঙ্গপ্রতেঙ্গের অসমাঞ্জস্যতাসহ আরো যত নিন্দা করা যায় সকল বিষয়। মুখে বলার দ্বারা যেমন গীবত হয়, তেমনি অঙ্গপ্রতেঙ্গের ভাব প্রকাশ করা দ্বারাও গীবত হয়।

গীবত একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগের বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ হুশিয়ার উচ্চারণ করেছেন। ভিন্নভাবে আদেশ করা হয়েছে এই গীবত করা থেকে বেঁচে থাকার। কারো প্রতি খারাপ ধারণা বা গীবত করা থেকে নিষেধ করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا

অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা কতক ধারণা গুনাহ। এবং তোমরা একে অন্যের দোষ ত্রুটি অন্বেষণ করো না এবং পরস্পর গীবত করো না। (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১২)

গীবত করার স্বরূপ কী? এর জবাবটা আমরা পবিত্র কোরাআনুল কারিমে দেখতে পাই। স্বয়ং আল্লাহ গীবতের স্বরূপ বা দর্শন কি বর্ণনা দিচ্ছেন। ঘোষণা হচ্ছে,

أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ

অর্থ : তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? (অন্যের গীবত করা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান) বস্তুতঃ কখনো তোমরা তা পছন্দ করবে না (ঘৃণাই করবে) সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী পরম দয়ালু’ (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১২)

একজন মুমিনের সবচে’ বড়ো পাওয়া হলো আল্লাহর রেজামন্দি। গীবতকারী কখনো আল্লাহর প্রিয় হতে পারে না। আল্লাহ গীবতকারীকে পছন্দ করেন না।

ঘোষণা হচ্ছে,

لَا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا

অর্থ : ‘মন্দ কথার (গীবত পরনিন্দা উপহাস) প্রচার করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। তবে কারো ওপর জুলুম করা হলে ভিন্নকথা। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী’ (সূরা নিসা, আয়াত: ১৪৮)

অবস্থা যতো বেগতিক হোক, যখন হোক সত্য কথা বলতে হবে গীবত করা যাবেনা।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বলো। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজগুলোকে শুদ্ধ করে দিবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করলো। (সূরা আহযাব, আয়াত: ৭০-৭১)

গীবত করা যিনার ব্যভিচারের চেয়ে নিকৃষ্ট: হাদিসে রয়েছে,

الغيبة اشد من الزنا هذا الحديث رواه الطبراني في الأوسط، والبيهقي في الشعب

হজরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- গীবত যিনার চেয়েও বড় গুনাহ (মিশকাত, হাদিস নং ৪৮৭৪)

গীবত বিদ্রুপ পরনিন্দা করা নিষেধ করে বলা হয়েছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

অর্থ : হে ঈমানদারগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ (গীবত উপহাস ব্যঙ্গ পরনিন্দ) না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য কোনো নারীকে বিদ্রুপ (গীবত উপহাস ব্যঙ্গ পরনিন্দ) না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা (গীবত) করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো জালিম’ (সুরা: হুজরাত, আয়াত: ১১)

হাদিসেও রয়েছে এই নিষেধের বার্তা। ঘোষণা হচ্ছে-

وَعَنْ أَبي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ سَمِعَ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: إنَّ الْعَبْد لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمةِ مَا يَتَبيَّنُ فيهَا يَزِلُّ بهَا إِلَى النَّارِ أبْعَدَ مِمَّا بيْنَ المشْرِقِ والمغْرِبِ. متفقٌ عليهِ

হজরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় বান্দা এমন কিছু কথা বলে যার পরিণাম সম্পর্কে সে নিজেও চিন্তা করে না। অথচ একথা বলার কারণে সে নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামের এমন গভীরে যার দূরত্ব মাশরিকের দূরত্বের চেয়ে অধিক’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০৩৩)

গীবতকারীর আনুগত্য করা সম্পর্কে বলা হয়েছে,

وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَهِينٍ هَمَّازٍ مَشَّاءٍ بِنَمِيمٍ مَنَّاعٍ لِلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيمٍ

অর্থ : আর তুমি আনুগত্য করো না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছিত, পিছে নিন্দাকরী (গীবত) ও যে চোগলখুরি করে বেড়ায়, ভালো কাজে বাঁধাদানকারী অপরাধী, দুষ্ট প্রকৃতির তারপর জারজ (এসব লোকদের আনুগত্য কখনো নয়) (সূরা কালাম, আয়াত: ১০-১৪)

গীবতকারী ঠিকানা জাহান্নাম। আল্লাহ তাকে অপছন্দ করার সঙ্গে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেই কথাই বলছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাদিসের বাণীতে। ঘোষণা হচ্ছে,

وَعَنْ ابي هريرة رضي الله عنه قال، عن النبيّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: إنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالكَلِمةِ مِنْ رِضْوَانِ اللَّهِ تَعَالى مَا يُلقِي لهَا بَالًا يَرْفَعُهُ اللَّه بهَا دَرَجاتٍ، وَإنَّ الْعبْدَ لَيَتَكلَّمُ بالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللَّهِ تَعالى لا يُلْقي لهَا بَالًا يهِوي بهَا في جَهَنَّم رواه البخاري.

অর্থ : হজরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনো কথা উচ্চারণ করে, অথচ সে কথার গুরুত্ব সম্পর্কে তার জানা নেই। কিন্তু একথা বলার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেন। আবার অনেক সময় বান্দার আল্লাহর অসন্তুষ্টি কোনো কথা বলে ফেলে, যার পরিণাম সম্পর্কে সে সচেতন নয়, অথচ ওই কথা বলার কারণে সে জাহান্নামে পতিত হবে’ (বুখারি হাদিস, ৬০৩৪)

গীবতকারীদেও বিপদগামী ঘোষণা করে বলা হয়েছে,

وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ

অর্থ : পিছনে (গীবতকারী) ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ ও ধ্বংস। যে সম্পদ জমা করে এবং বার বার তা গণনা করে, সে মনে কারে তার সম্পদ তাকে চিরজীবি করবে, কখনো নয়, অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়, (হুতামা একটি জাহান্নামের নাম) আর কিসে তোমাকে জানাকে হুতামা কি? আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন। যা হৃৎপি- পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয় তা তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখবে, প্রলম্বিত স্তম্ভসমূহে। (সূরা হুমাযাহ, আয়াত: ০১-০৯) মেরাজের রাত্রিতে রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাত জাহান্নাম পরিদর্শনকালে জাহান্নামে একদল লোকের ভয়াবহ শাস্তি দেখলেন। হজরত জিবরাইল আমিন আলাইহিস সালামকে এর কারণ জিজ্ঞাস করলেন যে, এরা কারা? জিবরাইল আমিন আলাইহিস সালাম উত্তরে বললো- এরা চোগলখোর, গীবতকারী, পরনিন্দাবাদী। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয় এদুটি কবরের শাস্তি হচ্ছে। তবে বড় কোনো অপরাধের কারণে শাস্তি নয়। ছোট (মানুষে চোখে ছোট, যা মানুষ বা সমাজ ছোট মনে করে না) অপরাধ। এই কবরওয়ালাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে সে প্রশ্রাবের সময় সতর্কতা অবলম্বন করেনি, (পাক নাপাকের দাড় দাড়েনি) ওই কবরওয়ালা মানুষের গীবত করে বেড়াত।

হাদিসটি নিন্মরূপ-

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى قَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا يُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِى كَبِيرٍ أَمَّا هَذَا فَكَانَ لاَ يَسْتَنْزِهُ مِنَ الْبَوْلِ وَأَمَّا هَذَا فَكَانَ يَمْشِى بِالنَّمِيمَةِ

হজরত হাফিজ্জী হুজুর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন- গীবত তো এখন ঘি-ভাত হয়ে গিয়েছে। ভাতের সঙ্গে ঘি মাখানোর দ্বারা যে স্বাদ লাগে। আমাদের সমাজে কথায় কথায় গীবত করলে সেই স্বাদ লাগে। একারণে মানুষ গীবতের মাঝে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এই মহাবিপদ থেকে আমাদের সকলের বাঁচতে হবে।

নিউজওয়ান২৪/আরএডব্লিউ