ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

ওজু: পবিত্রতা অর্জনের একটি পন্থা

আব্দুল রাফি আব্দুল্লাহ

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

 

ইসলামের বিধান অনুসারে, ওজু হলো দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের একটি পন্থা। 

পবিত্রতা অর্জনের জন্য ওজু করা হয়। শরীয়তের বিধান মতে পবিত্র পানি দিয়ে শরীরের কতিপয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধোয়াকে ওজু বলে।

শরীয়তে ওজুর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। দেহ ও পরিধেয় কাপড়ের পবিত্রতা অর্জনকে বলে তাহারাত্‌। ওজু বা গোসলের মাধ্যমে তাহারাত্‌ অর্জন করা যায়।

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ধর্মের অর্ধেক।’ (সহীহ মুসলিম)

এসম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তহাদিগকেও ভালবাসেন।’ (সূরা: আল- বাকারা, আয়াত: ২২২)

পবিত্র কোরআন শরীফ পড়তে ও স্পর্শ করতেও ওজু করতে হয়। পবিত্র কোরআনে আছে, ‘যাহারা পূত-পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করো না।’ (সূরা: ওয়াক্কিয়াহ‌, আয়াত:৭৯)

ওজুর পদ্ধতি:

ওজু করার দুটো পদ্ধতি রয়েছে-

(ক) ফরজ পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে-

(১) সমস্ত মুখমণ্ডল একবার ধৌত করা। এর মধ্যে- গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেয়াও অন্তর্ভুক্ত হবে।

(২) কনুই পর্যন্ত হাত একবার ধৌত করা।

(৩) সমস্ত মাথা একবার মাসেহ করা। এর মধ্যে কানদ্বয় মাসেহ করাও অন্তর্ভুক্ত হবে।

(৪) দুই পায়ের টাকনু পর্যন্ত একবার ধৌত করা।

পূর্বোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘একবার’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট অঙ্গের কোনো অংশ যেন ধোয়া থেকে বাদ না পড়ে।

(৫) এই ক্রমধারা বজায় রাখা। অর্থাৎ প্রথমে মুখমণ্ডল ধৌত করবে, এরপর হাতদ্বয় ধৌত করবে, এরপর মাথা মাসেহ করবে, এরপর পা দুইটি ধৌত করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ক্রমধারা বজায় রেখে ওজু করেছেন।

(৬) পরম্পরা রক্ষা করা। অর্থাৎ উল্লেখিত অঙ্গগুলো ধৌত করার ক্ষেত্রে পরম্পরা রক্ষা করা; যাতে করে একটি অঙ্গ ধোয়ার পর অপরটি ধোয়ার মাঝখানে স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের বিরতি না পড়ে। বরং এক অঙ্গের পরপর অপর অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ধৌত করা।

এগুলো হচ্ছে- ওজুর ফরজ কাজ; ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যে কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে।

এ কাজগুলো ওজুর ফরজ হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণী:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُواْ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُواْ بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُواْ وَإِن كُنتُم مَّرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاء أَحَدٌ مَّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاء فَلَمْ تَجِدُواْ مَاء فَتَيَمَّمُواْ صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُواْ بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُم مِّنْهُ مَا يُرِيدُ اللّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَـكِن يُرِيدُ لِيُطَهَّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ    

‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও; এবং যদি তোমরা জুনুবী অবস্থায় থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে, বা তোমরা স্ত্রী সহবাস কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে: তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে। আল্লাহ তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।’(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬)

(খ) মুস্তাহাব পদ্ধতি: 

যা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে; ওজুর বিস্তারিত পদ্ধতি নিম্নরূপ:

(১) ব্যক্তি নিজে পবিত্রতা অর্জন ও হাদাস (ওজু না থাকার অবস্থা) দূর করার নিয়ত করবে। তবে নিয়ত উচ্চারণ করবে না। কেননা নিয়তের স্থান হচ্ছে- অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই নিয়তের স্থান অন্তর।

(২) বিসমিল্লাহ বলবে।

(৩) হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধৌত করবে।

(৪) এরপর তিনবার গড়গড়া কুলি করবে (গড়গড়া কুলি: মুখের ভেতরে পানি ঘুরানো)। বাম হাত দিয়ে তিনবার নাকে পানি দিবে ও তিনবার নাক থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে দিবে। ‘ইস্তিনশাক’ শব্দের অর্থ- নাকের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করানো। আর ‘ইস্তিনসার’ শব্দের অর্থ- নাক থেকে পানি বের করে ফেলা।

(৫) মুখমণ্ডল তিনবার ধৌত করবে। মুখমণ্ডলের সীমানা হচ্ছে- দৈর্ঘ্যে মাথার স্বাভাবিক চুল গজাবার স্থান থেকে দুই চোয়ালের মিলনস্থল ও থুতনি পর্যন্ত। প্রস্থে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত। ব্যক্তি তার দাঁড়ি ধৌত করবে। যদি দাঁড়ি পাতলা হয় তাহলে দাঁড়ির ওপর ও অভ্যন্তর উভয়টা ধৌত করবে। আর যদি দাঁড়ি এত ঘন হয় যে চামড়া দেখা যায় না তাহলে দাঁড়ির ওপরের অংশ ধৌত করবে, আর দাঁড়ি খিলাল করবে।

(৬) এরপর দুই হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। হাতের সীমানা হচ্ছে- হাতের নখসহ আঙ্গুলের ডগা থেকে বাহুর প্রথমাংশ পর্যন্ত। ওজু করার আগে হাতের মধ্যে আঠা, মাটি, রঙ বা এ জাতীয় এমন কিছু লেগে থাকলে যেগুলো চামড়াতে পানি পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেগুলো দূর করতে হবে।

(৭) অতঃপর নতুন পানি দিয়ে মাথা ও কানদ্বয় একবার মাসেহ করবে; হাত ধোয়ার পর হাতের তালুতে লেগে থাকা অবশিষ্ট পানি দিয়ে নয়। মাসেহ করার পদ্ধতি হচ্ছে- পানিতে ভেজা হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনের দিকে নিবে; এরপর পুনরায় যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। এরপর দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানের ছিদ্রতে প্রবেশ করাবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠদ্বয় মাসেহ করবে। আর মহিলার মাথার চুল ছেড়ে দেয়া থাকুক কিংবা বাঁধা থাকুক; মাথার সামনের অংশ থেকে ঘাড়ের ওপর যেখানে চুল গজায় সেখান পর্যন্ত মাসেহ করবে। মাথার লম্বা চুল যদি পিঠের ওপর পড়ে থাকে সে চুল মাসেহ করতে হবে না।

(৮) এরপর দুই পায়ের কা’ব বা টাকনু পর্যন্ত ধৌত করবে। কা’ব বলা হয় পায়ের গোছার নিম্নাংশের উঁচু হয়ে থাকা হাড্ডিদ্বয়কে। দলিল হচ্ছে ইতিপূর্বে উল্লেখিত হজরত ওসমান (রা.) এর ক্রীতদাস হুমরান এর বর্ণনা যে, একবার হজরত ওসমান বিন আফফান (রা.) ওযুর পানি চাইলেন। এরপর তিনি ওযু করতে আরম্ভ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন), হজরত ওসমান (রা.) হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধুইলেন, এরপর কুলি করলেন এবং নাক ঝাড়লেন। এরপর তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন এবং ডান হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর বাম হাত অনুরূপভাবে ধুইলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাসেহ করলেন। এরপর তার ডান পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর অনুরূপভাবে বাম পা ধুইলেন। তারপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার এ ওযুর করার ন্যায় ওজু করতে দেখেছি এবং ওজু শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ ওজুর ন্যায় ওজু করবে এবং একান্ত মনোযোগের সাথে দু' রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির পিছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’(সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৩১)

ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে- ইসলাম গ্রহণ করা, আকলবান হওয়া, বুঝদার হওয়া ও নিয়ত করা। এসব শর্তের কারণে কোনো কাফের ওজু করলে ওজু হবে না। পাগলের ওজু হবে না। বুঝদার হয়নি এমন শিশুর ওজু হবে না। নিয়ত করেনি এমন ব্যক্তির ওজু হবে না; উদাহণতঃ কেউ যদি ঠাণ্ডা উপভোগ করার নিয়তে এ অঙ্গগুলো ধৌত করে। ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য পানি পবিত্রকারী হতে হবে। নাপাক পানি দিয়ে ওজু শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব বস্তু চামড়াতে ও নখে পানি পৌঁছতে বাধা দেয় সেসব জিনিস দূর করতে হবে; যেমন- মহিলাদের নখের মধ্যে ব্যবহৃত নেইল পলিশ।

জমহুর আলেমের মতে, ওজুতে বিসমিল্লাহ পড়ার বিধান রয়েছে। তবে আলেমেরা মতানৈক্য করেছেন— বিসমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব নাকি মুস্তাহাব? ওজুর শুরুতে কিংবা মাঝখানে যে ব্যক্তির স্মরণে থাকে তার উচিত বিসমিল্লাহ পড়া।

পুরুষ ও মহিলার ওজু করার পদ্ধতিতে কোনো পার্থক্য নেই।

ওজু সমাপ্ত করার পর এই দোয়া বলা মুস্তাহাব: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ওজু করে এবং পরিপূর্ণভাবে পানি পৌঁছায় কিংবা (বলেছেন) পরিপূর্ণভাবে ওজু করে এরপর বলে: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’ (অর্থ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল) তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজায় খুলে দেয়া হয়। সে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে’(সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত
৩৪৫; সুনানে তিরমিযিতে আরেকটু অতিরিক্ত এসেছে যে, ‘আল্লাহুম্মাজ আলনি মিনাত্তাওয়্যাবীন ওয়াজ আলনি মিনাল মুত্বাতাহ্হিরীন’ (অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে আপনি তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন) (সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে (৪৮) আলবানী হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন)

শেষে, মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার হেদায়াত ও সাহায্য কামনা করে এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করে শেষ করছি।

প্রিয়নবী (সা.) এর প্রতি দরুদ পড়া সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারীমে বলেন,

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا    

‘নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোয়া-ইসতেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর ওপর সালাত (দরুদ) পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’(সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৬)

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

নিউজওয়ান২৪/আরএডব্লিউ