বিশ্বযুদ্ধে শ্মশানে পরিণত স্তালিনগ্রাদ হতে যাচ্ছে মসুলের ভাগ্য!
বিশ্ব সংবাদ ডেস্ক
নিউজওয়ান২৪.কম
প্রকাশিত : ০৭:৪৫ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০১৬ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৬ শুক্রবার

ফাইল ফটো
গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ইরাকে আইএসের শক্ত ঘাঁটি মসুল শহরে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে বলে সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।
গত সোমবার মার্কিন-ব্রিটিশ ও ইরাকি সেনাদের জোট মসুলকে আইএসমুক্ত করতে অভিযান শুরু করে। এই সংবাদ যখন লেখা হচ্ছে তখন ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলে চলছে ভয়াবহ বিমান হামলা, গোলাবাজী আর আত্মঘাতী ফেদাইনদের তুমুল বিভীষিকাময় যুদ্ধ। যুদ্ধাস্ত্রের বিভীষিকাময় বিস্ফোরণের শব্দ আর হতাহত মানুষের আর্তচিৎকারে নরক গুলজার অবস্থা বিরাজ করছে শহরজুড়ে।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, আইএস যোদ্ধারা সরকারি ও মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মসুল উদ্ধারে যৌথ বাহিনী বড় ধরনের হামলা করতে যাচ্ছে বোঝার পর থেকে আইএস জঙ্গিরা তাদের অবস্থান ঘিরে গভীর পরিখা খনন করে। এরপর তাতে তেল ঢেলে ভর্তি করে রাখে। হামলা শুরু হলে তেলভর্তি ওই পরিখার খালে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই জ্বলে ওঠা ভয়াবহ অগ্নিবলয় ভেদ করে পদাতিক যোদ্ধাদের অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একইসঙ্গে আগুন থেকে ওঠা কালো ধোঁয়া জঙ্গিদের অবস্থানে হামলা চালাতে আসা যুদ্ধবিমানের জন্য অপ্রত্যাশিত কঠিন প্রতিরোধ করে তোলে।
এ অবস্থায় যৌথ বাহিনীও মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আইএসকে পরাস্ত করতে। ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভয়বহতম রূপ নিয়েছে। অনেকেই বলছেন- ইতিহাসের ভয়াবহতম রক্ষক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়েছে এখন মসুলে।
আকাশপথে হামলা ঠেকাতে আইএস শহরের নিরপরাধ সাধারণ নাগরিক বিশেষ করে শিশু ও নারীদের ব্যবহার করছে বলে খবরে জানা গেছে। তারা শহরের উঁচু ভবনগুলোতে নারী ও শিশুদের দিয়ে মানব ঢাল তৈরি করে রেখেছে যাতে যৌথ বাহিনী হামলা না চালায়। এই কাপুরুষোচিত রণকৌশল ছাড়াও তারা মসুল শহরের দুই অংশকে যুক্ত করা টাইগ্রিস নদীর ওপরের ব্রিজটিতে বারুদভর্তি পাইপ বিছিয়ে রেখেছে। মোটকথা নরককুণ্ড বানিয়ে রাখা হয়ছে মসুলকে।
এমন অবস্থায় শহরটিতে লাখ লাখ নিরপরাধ নাগরিক অবরুদ্ধ হয়ে আছে। গত কয়েকদিনে হামলা শুরুর আগে অনেকেই শহর ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করে। তবে তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক ভাগ্যবানই সফল হয়েছে। পালাতে চাওয়া বাসিন্দারা আইএসের হাতে ধরা পড়লেই তাদের সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মারা হবে- এমন অবস্থাই বিরাজ করছে। তাই ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে আছেন এখন সেখানকার সাধারণ মানুষ।
পত্রিকার প্রতিবেদনগুলোতে বলা হচ্ছে- ইরাকে হানাহানি, আত্মঘাতী বোমাবাজী, মুখোমুখি লড়াইয়ে বিশাল সংখ্যায় মানুষ মারা যাওয়া বর্তমানে অনেকটাই মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) মসুলে যে নৃশংসতার শুরু হতে হচ্ছে তা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবে। কয়েক লাখ নিরপরাধ মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে আছে- আর আইএস নিজেদের রক্ষায় তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে যা ইচ্ছা তাই করছে। অপরদিকে, যৌথবাহিনীও আইএসকে হঠাতে গিয়ে ওইসব নাগরিকদের কথা থোরাই কেয়ার করছে।
বিশেষ করে, ইয়েমেন, ইরাক, আফগানিস্তানে অনেকবারই দেখা গেছে বেসামরিক এলাকায় এমনকি বাচ্চাদের স্কুলেও মিসাইল হামলা চালিয়ে মার্কিন বাহিনী হত্যা করেছে অসংখ্য নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে। পরে তারা জানিয়েছে, এরকম ভুল করে হয়ে গেছে। কিন্তু মসুলের যে অবস্থা এখন- তাতে এইরকম ‘ভুল’ বা ‘সঠিক’ কাজের গোনাগারি কিন্তু নিরপরাধ সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে- হোক তা আইএসের করা কিংবা যৌথবাহিনীর করা।
মোট কথা, মানবতা এখন ডুঁকরে কাঁদছে মসুলে। মসুলের পরিস্থিতি বোঝাতে ডেইলি মেল সেখানকার এক বাসিন্দার অবস্থা বয়ান করেছে। তিনি সেখানকার এক অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে সব শেষ। গত দুই বছর ধরে তিনি প্রার্থনা করে আসছেন আইএসের শেষ দেখার আশায়। কিন্তু এখন যখন মার্কিনিদের নেতৃত্বে সরকারি বাহিনী মসুল শহরের দ্বারপ্রান্তে, তখন মনে হচ্ছে মসুলে আইএসের ধ্বংস হয়তো হতে যাচ্ছে- কিন্তু তা দেখার জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন না।
পরিস্থিতি এমন যে আরও হাজার হাজার মানুষ আগামী কয়েক ঘণ্টা পর হয়তো আর বেঁচে থাকবেন না। এবারকার মসুল অভিযান মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর জন্য এক এসিড টেস্ট। একে তারা মনে করছে- আইএসের ‘শেষের শুরু’ হিসেবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এটা হতে যাচ্ছে একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী লড়াই। ইরাকি ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে এবারকার অভিযানে যুক্ত আছে মার্কিন ও ব্রিটিশ যোদ্ধারা, আছে তাদের চূড়ান্ত শক্তিধর বিমান বাহিনী।
অনেকেই মনে করছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনগ্রাদ কব্জা করতে রুশ আর জার্মান সৈন্যদের মরণপণ লড়াইয়ে শহরটি যেমন প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়- তেমনি পরিণতি হতে যাচ্ছে মসুলের। আগামী কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে যুদ্ধের ফয়সালা হতে- কিন্তু তারপর পরিস্থিতি এমনি দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ মুহূর্তে মসুলে প্রায় দশ লাখ সাধারণ নাগরিক রয়েছে। আইএস তাদের সবাইকে নিজেদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করবে- আপাতত এটাই নিশ্চিত। আত্মরক্ষার্থে তাদের সঙ্গে থাকা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এটাই।
আরও পড়ুন আইএস জঙ্গিরা মসুল ছেড়ে পালাচ্ছে মেয়েদের পোশাকে!
ইরাকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ব্রুনো গেডি সাবধান করে দিয়ে বলেন- এই অভিযানের পরিণতি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মনুষ্য সৃষ্ট সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় হিসেবে স্থান করে নেবে। তার সংস্থা সম্প্রতি মসুল থেকে পালিয়ে আসা সাত লাখ শরণার্থীকে খাবার, তাবু ও ঔষধ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তার মতে, এই অভিযানের পরিণতি ‘সর্বনাশ’ ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রসঙ্গত, সিরিয়া সীমান্ত থেকে মসুলের দূরত্ব মাত্র ১০০ মাইল। সিরিয়া আর ইরাক দুই প্রতিবেশী দেশে নিজেদের কর্মকাণ্ড জারি রাখতে মসুল বড় ভূমিকা রাখে ইসলামিক স্টেট তথা আইএসের জন্য। তেলসমৃদ্ধ এই মসুল দখলে নেওয়ার পরই দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয় আইএস।
এই সেই মসুল যেখানে ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হয় ইরাকের সাবেক দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক সাদ্দামের দুই পুত্র। একসময় এই মসুল ছিল পাশ্চাত্যের যে কোনো শহরের মতো শান-শৌকতে পূর্ণ। অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকতে হোটেল-রেস্তরাঁ-বার। মদ্যপান বা মদ বিক্রিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। জীবনযাত্রা ছিল প্রায় পাশ্চাত্যধারার। আনন্দ-স্ফূর্তির এক মিলন মেলা হামেশাই লেগে থাকতো যেন এখানে।
এখন সেই শহরে খানিক পরপর রাস্তায়, মাঠে রক্তের দাগ, বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপ, দীর্ঘসময় ধরে রাস্তায় মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে থাকা খুব সাধারণ ব্যাপার যেন। পুরনো বাসিন্দাদের কাছে শহরের এই হাল আদপে এক দুঃস্বপ্নের মতোই যা বিরামহীনভাবে তারা দেখছে গত তিন বছর ধরে।
নিউজওয়ান২৪.কম/একে