NewsOne24

যিনি জুতো সেলান তিনি কবিতাও লেখেন!

ফিদা নূর সুদর্শন

নিউজওয়ান২৪

প্রকাশিত : ০১:৪৮ পিএম, ২২ জুলাই ২০১৫ বুধবার | আপডেট: ১২:০৯ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার

মানুষের বহুমুখী কর্মদক্ষতার বিষয়ে বাংলায় প্রচলিত একটি কথা আছে। এটা হচ্ছে জুতো `সেলাই থেকে চণ্ডি পাঠ পর্যন্ত`। এবার বাস্তবে প্রায় এমনি একজনের সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে পাকিস্তানে।

মুনাব্বার শাকিল। পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের জরনবালা এলাকার বাসিন্দা। তার পেশাটা কী তা ছবি দেখেই বুঝে গেছেনে সবাই। গত তিন দশক ধরে এলাকার রোডালা কলোনিতে রাস্তার পাশে বসে জুতা মেরামতের কাজ করছেন। এ ধরনের পেশাজীবীদের আমরা মুচি বলেও সম্বোধন করি।  

লোকজনের ফেটে যাওয়া জুতো বা ছিড়ে যা্ওয়া স্যান্ডেল-চপ্পল সেলাই করেই দুবেলার রুটি যোগার হয় তার। তবে আজকাল লোকজন তার কাছে জুতো সেলাই বা পালিশের প্রয়োজনে না, তারা যাচ্ছে মুনাব্বারের কবিতা শোনার জন্য। 

পাকিস্তানি পত্রিকা জানায়, জীবনের টক-ঝাল-মিষ্টি-তেতো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তার রচিত তার কবিতা শুনতে লোকজন এখন তার কাছে জড়ো হয়।

হুট করে গজিয়ে ওঠা কবিও কিন্তু তিনি নন। পাঞ্জাবী ভাষায় পাঁচ পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ্ এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে মুনাব্বারের। দরিদ্র মানুষের জীবনের সকরুণ পাঁচালি বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে তার ছান্দসিক শব্দ চয়নে। মোটকথা তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের কবি।

১৯৬৯ সালে জন্ম নেওয়া এই অসাধারণ কবি শিশুকালেই পিতাকে হারান। এর ফলে অকূল পাথারে পড়ে যাওয়া মুনাব্বারের স্কুলে যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। কিন্তু প্রকৃতিদত্ত প্রতিভার গুণে ১৩ বছর বয়স থেকেই তিনি শুরু করেন কাব্য রচনা।

চরম সংঘর্ষময় জীবন চলার ধারাবহিকতায় ২০০৪ সালে এই স্বভাব কবির জীবনে আসে চরম সুখের ক্ষণ- সেবার তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ `সোচ সামান্দার` প্রকাশ হয়।

মুনাব্বার জানান, জুতো মেরামত তার পারিবারিক পেশা। দোকানে বসে জুতো মেরামত আর পত্রিকা বিক্রি করে দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ রুপিয়া রোজগার হয়। এর থেকে ১০ রুপিয়া আলাদা করে রাখেন নিজের পরবর্তী বই প্রকাশের খরচা মেটানোর জন্য। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ `পরদেশ দি সঙ্গত` প্রকাশ হয় ২০০৫ সালে।

অসাধারণ সংগ্রামী এই কবি বলেন, "আমি আমার কবিতার মাধ্যমে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের কথা বলতে চাই। যেসব কথা সরাসরি বলা যায় না সেসব কথাই আমি বলতে চাই ছন্দের ছত্রে ছত্রে।"

মুনাব্বারের কবিতা কতটা গভীর অর্থবোধক, কতটা আবেগঘন চেতনার উৎসারী তার নমুনা পাওয়া যাবে নিচের দুটি লাইনে-

"ইন্নু কিন্নে পানি দিত্তা, ইন্নু কিন্নে বয়া আয়ে

পাত্থার দে জো সিনে উট্টে, বুতা উকায়া হোয়া আয়ে!"

অর্থাৎ

প্রস্তর হৃদয়ে জন্মালো তরু সজীব;

কে দিলো পানি এতে, কে দিলো বীজ!

অভাবের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা জোটেনি, কিন্তু মুনাব্বার বাইরের বই-পুস্তক পড়াশোনা কেমন করেছেন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, "শিশু বয়সে আমি পড়াশোনার জন্য পাগল ছিলাম। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর অভাবে অনটনে তা সম্ভব হয়নি। তবে এরপর আমি নিজে থেকে বই কিনে পড়া শুরু করি। পড়ার অভ্যাস আমার এতটাই কঠিন হয়ে পড়েছে এখন যে রোজ কাজ শেষে ৪ ঘণ্টা বই না পড়ে ঘুম হয় না আমার।"

পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষাগুলোর কয়েকটি জানা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চার জন্য শুধুমাত্র মাত্রভাষা পাঞ্জাবীকেই বেছে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাঞ্জাবী হচ্ছে পাঞ্জাবীদের মাতৃভাষা। আর এই ভাষায় লেখাপড়া তাদের মৌলিক অধিকার। সরকারের কাজ হচ্ছে পাঞ্জাবীসহ সবগুলো আঞ্চলিক ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া।

কেউ কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চরম প্রকাশক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন `মুচি` ছাড়াও `চামার` শব্দটিও। এসব বিষয়ে ইঙ্গিত করে এই মেধাবী কবি আরও বলেন, "কঠোর পরিশ্রমের পরিণতি হচ্ছে যশ-গৌরব। জুতো মেরামতে কোনো লজ্জা নেই, তবে আমি চাই লোকজন আরো সচেতন হোক। আর আমি চাই আমার জাতির লোকজন বই পড়ুক যাতে করে আমরা উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে পারি।"

তার সহিত্যগুরু গোলাম মুস্তাফা আজাদ নাকভীর মতে, মুনাব্বারের কবিতায় নিপীড়িত মানুষের কষ্টবেদনা অনুরণিত হয়, নৈমিত্তিক প্রেমবিরহ-অভিসারের রূপকল্পের চেয়ে অনেক অনেক দূরে এর আস্তানা। নিচুশ্রেণির মানুষের রোজকার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আক্ঙ্ক্ষা আর কাঠিন্যের কাছাকাছি এর অবস্থান। 

নিউজওয়ান২৪.কম/এমএ