NewsOne24

মদপান-উৎপাদন দুটোই বাড়ছে ৯৭% মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে

সার্ক অঞ্চল ডেস্ক

নিউজওয়ান২৪.কম

প্রকাশিত : ০৩:২০ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বুধবার | আপডেট: ১১:৪০ এএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সোমবার

এক আধ ফোঁটায় আর হচ্ছে না পাকিস্তানিদের- ঘরে তৈরি হুইস্কি সংরক্ষণ করছেন ইসলামবাদের এক যুবক

এক আধ ফোঁটায় আর হচ্ছে না পাকিস্তানিদের- ঘরে তৈরি হুইস্কি সংরক্ষণ করছেন ইসলামবাদের এক যুবক

অতি কট্টরভাবে মদ্যপান পরিহারকারী জাতি হিসেবে পরিচিত পকিস্তানিরা। তবে রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত মহাশক্তিধর আর্মি হেডকোয়ার্টারের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত মারি ব্রিউয়ারি নামের মদের কারখানায় প্রতিবছর কমপক্ষে এক কোটি লিটার বিয়ার উৎপাদন করা হয়। সে অনুপাতে জিন হুইস্কি তো আছেই।

ঠাঠা রোদের কর্কশ চুম্বন থেকে বাঁচাতে বৃটিশ আমলে তৈরি লাল ইটের ঐতিহ্যবাহী দালানে অবস্থিত মারি ব্রিউয়ারি কোম্পানির মাটির নিচের সেলারের বিশেষ সংরক্ষণাগারে মওজুদ থাকে শত শত টন মহার্ঘ জিন আর হুইস্কি।

দৃশ্যত মদ্যবিরোধী পাকিস্তানের বিশাল পরিমাণে মদ্য উৎপাদনের এই কাহিনী বাইরের দুনিয়ার কেউ জানে, কেউ জানে না। মোট কথা, কট্টরতার পরাকাষ্ঠা আর তালেবানি চিন্তা-চেতনার উর্বরভূমি পাকিস্তানিদের এক আধটু মদ চেখে দেখার স্বাদের অনেকটাই পূরণ করে এই মদের কারখানাটি, আবার বিদেশে রপ্তানিও করে। এর বাইরে নানান প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কায়দায় বিদেশ থেকে হরেক পদের মদের সরবরাহও কম নয় দেশটিতে।

কিন্তু হাল আমলের হিসেব হলো- এক আধ ফোঁটায় আর হচ্ছে না পাকিস্তানিদের- দিন দিন মদের ব্যবহার বাড়ছে দেশজুড়ে। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় প্রকাশ্য আর অপ্রকাশ্য কারখানাগুলোতে মদিরা উৎপাদন এবং বিক্রি-বাট্টা বেড়েই চলেছে।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের ৯৭% মানুষের কাছে মদ হারাম। তবে মুসলিমদের জন্য মদ্যপান নিষিদ্ধ হলেও সংখ্যালঘু হিন্দু-খ্রিস্টানদের জন্য তা নয়, তারা হরহামেশাই নিজেদের কোটামতো মদের সরবরাহ পেতে পারে। এটাকেই শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করে উঁচুতলার পাকিস্তানি মুসলিমরা। সংখ্যালঘুদের কোটায় মেলা মদে ভাগ বসায় তারা।

আর তাই, বর্তমানে সরকারিভাবে দেশটির তিরিশ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক (অমুসলিম) মদপানের অনুমোদন পেলেও দেশের তিনটি মদের কারখানার শ্রমিকরা উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যান সাধারণ থেকে পাঁড় মাতালদের চাহিদা মেটাতে- অর্থাৎ, পাকিস্তানে দিন দিন বাড়ছে মদের চাহিদা।

তবে মারি ব্রিউয়ারির প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানিদের হাতে হয়নি- এই নিয়ে এক ধরনের ‘গর্ব’ করতেই পারে পাকিস্তানিরা- যদিও ‘সুবিধার পুরোটাই’ ভোগ করছে তারা। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তন করে আর বর্তমানের মালিকানা পার্সিদের হাতে। শুদ্ধি অভিযান চলাকালে মুসলিমদের বিক্ষোভের মুখে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয় একবার। উগ্র বিক্ষোভকারীরা আগুনও ধরিয়ে দিয়েছিল কারখানায়।

তবে ১৯৭০ এর দশকে জারি করা নিষেধাজ্ঞার মারপ্যাঁচ বাঁচিয়ে টিকে আছে এখনও মদওয়ালাদের ব্যবসাপাতি। এর পেছনে অপ্রকাশ্য ভূমিকায় অবশ্যই আছে ক্ষমতাশালী মহলের কেউ কেউ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের ধারক বাহক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মদ্যপ্রীতি একটা সময় এক ধরনের আভিজাত্যের ধারক ছিল। বাংলাদেশে আত্মসর্মণ করা জেনারেল নিয়াজি এবং স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার মদ্যপান, মাতলামি আর নারী লিপ্সুতা নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

মোদ্দা কথা হলো, মারি ব্রিউয়ারিকে হরহামেশা সন্ত্রাসবিঘ্নিত পাকিস্তানের শিল্পবাণিজ্য ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ বলা যায়। এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫-২০% যা দেশটির অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিরল।

মদের কারখানার নির্বাহীদের একজন মেজর সাবিহুর রেহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান দেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের একটি এবং খুবই আইনসম্মত একটি প্রতিষ্ঠান, এর কোনো ঝুঁকি নেই। একটি আইনসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মারি ব্রিউয়ারির টিকে থাকা এবং বিস্তার লাভে আমাদের প্রত্যেকের স্বার্থ রয়েছে।

দেশটির মানুষজনের গড় বেতন যেখানে ১৩ হাজার রুপিয়া সেখানে বৈধ বাজারে এক ক্যান পাকিস্তানি বিয়ারের দাম ৩০০ রুপিয়া। কালোবাজারে দেশে তৈরি মারি জিন কিনতে হয় ২০০০ রুপিয়ার বেশি দামে, যদিও এর কোম্পানি ধার্যকৃত দাম অর্ধেকেরও কম। এর ওপরে কালোবাজারের মদের বেপারিরা আসলের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় সস্তা দরের স্পিরিট। টেবিলে পরিবেশনযোগ্য ভাল মানের মদের বোতলের দাম শুরেই হয় চার হাজারের ওপর থেকে।

পাকিস্তানের প্রভাবশালী ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ডনের এক প্রতিবেদনে বিষয়টির উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দৃশ্যত অভিজাত পয়সাওয়ালা মুসলিম যারা আইন ভেঙ্গে মদ্যপানে আগ্রহী, তারাই হচ্ছে মদওয়ালাদের আসল খদ্দের।

মাদকাসক্তি নিরাময় বিশেষজ্ঞ পাকিস্তানি থেরাপিস্ট তাহির আহমেদ দেশে হাল আমলে মাদকপ্রেমির বাড়বাড়ন্তে উদ্বিগ্ন। তার মতে, লাইসেন্সবিহীন মদের দোকানগুলোর ক্রেতা তারাই যারা তা কেনার সামর্থ্য রাখে- এবং পাকিস্তানে শুধু মুসলমানরাই সেই ক্ষমতা রাখে।
তবে এর সমান্তরালে সস্তাদরের এবং বিপজ্জনক উপাদানে তৈরি ‘দেশি’ মদও মেলে বাজারে- বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে এসব পান করে প্রায়ই শোকাতুর ঘটনার সৃষ্টি করে গরীব জনগোষ্ঠী।

তাহির বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইসলামি নৈতিকতার প্রবাহে ভাসমান, অপরদিকে উচ্চবিত্তরা আরও বিত্তবান হচ্ছে, আর এখন দেশে একটা নয়া চল হয়েছে যে, যদি কাউকে রাতের ভোজনে দাওয়াত করা হয়- তবে তাকে মদও খাওয়াতে হবে। সামাজিকভাবে এটা স্বীকৃত।

পাকিস্তানে প্রায়শ বার্থডে পার্টিগুলো বা বড়লোকের ডিনার আয়োজনে থাকে পর্যাপ্ত মদ্য সরবরাহ, ইতালীয় মদে প্রায়ই সয়লাব হয়ে যায় সেসব পার্টি। এর বাইরে বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলের (ওয়েডিং হল) পার্কি লটে উপস্থিত থাকে সুচতুর ভ্রাম্যমাণ মদওয়ালারা (কার-বার)। গাড়িতে স্থাপিত এসব কার-বারের মূল যোগানদাতা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে ডগমগিয়ে ওঠা ব্লাক মার্কেট- বিদেশ থেকে আনা রকমারি মদের অঢেল সরবরাহ রয়েছে তাদের।

নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টমস কর্মকর্তারা এএফপিকে জানান, চোরাই মদের মূল সরবরাহ আসে দুবাই থেকে- আরব সাগর পাড়ি দিয়ে লঞ্চে করে। কালোবাজারী চক্র শুল্ক কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করে পুরো কন্টেইনার ভর্তি মদও নিয়ে আসে।

এছাড়া ‘বেহায়া টাইপের’ অর্থগৃধ্নু কূটনীতিকদের অনেকেই তাদের কোটায় আনা মদ কালোবাজারে বেঁচে দেয়। এশীয় একটি দেশের অ্যাম্বেসি এখানে একসময় খোদ নিজেদের মালিকানায় মদের দোতান চালাতো- এমন নজিরও আছে।

ধনী সৌখিনদের অনেকেই আসল মদে কালোবাজারীদের ভেজাল মেলানোয় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে এখন নিজেরাই ঘরে তৈরি করছেন স্পেশাল কিসিমের মদ। এজন্য তাদের আঙুর উৎপাদনে বা কিনতে যেতে হয় না। বাজার থেকে বোতলজাত আঙুর-কমলার রস, কিসমিস, চিনি আর কিছু কেমিক্যাল দিয়ে ঘরেই তৈরি করা হচ্ছে মনপসন্দ মদ। ধনীর দুলালরা একাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠছে। এমন একজন সৌখিন মদ প্রস্তুতকারী হাসানের মতে- এটা একটা চমৎকার হবি। নিজের তৈরি জিনিস বন্ধুদের সঙ্গে পান করাটা বেশ মজার।

তবে হাসান যে হবিটায় এখন আসক্ত- পাকিস্তানে সে ধরনের শখ পোষণের শাস্তি ৮০টি চাবুকের আঘাত। তবে এটা হাসানের মতো সুরাসক্ত যুবকদের কখনো হতোদ্যম করেনি- কারণ, এ ধরণের শাস্তির মুখে তাদের কখনো পড়তেই হয় না।

নিউজওয়ান২৪.কম/একে