NewsOne24

সিরাজুল আলম খান রহস্য, একটি রাজনৈতিক বিতর্ক

সাইফুল ইসলাম

নিউজওয়ান২৪.কম

প্রকাশিত : ১১:০১ এএম, ১৪ জুন ২০১৬ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:৪৭ পিএম, ১৭ জুন ২০১৬ শুক্রবার

আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ ও সিরাজুল আলম খান

আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ ও সিরাজুল আলম খান

যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন, তাদের সামনে ‘নিউক্লিয়াস’ শব্দটি মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে আবার ডুবে যায়। এই ডুবসাঁতার খেলা সৃষ্টি করে এক ধরণের কৌতুহল।

নিউক্লিয়াস নেতা সিরাজুল আলম খানকে নিয়েও কৌতুহলের শেষ নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হয় তা অন্য কোন রাজনীতিকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। নিউক্লিয়াস ও তার নেতা সিরাজুল আলম খানকে বলা হয়, ‘র’ ‘কেজিবি’ এদের স্রষ্টা, আবার সম্পূর্ণ বিরোধী ধারার সিআইএ-মোসাদের নামও যুক্ত হয়েছে এদের সৃষ্টি তত্ত্বের সাথে।

সিরাজুল আলম খানের নামের সাথেও যুক্ত হয়েছে নানা খেতাব। খেতাবগুলোর মধ্যে মুজিবের গুণ্ডা, মুজিব বিরোধী, তাত্ত্বিক নেতা, কাপালিক, আন্দোলনকারী, যড়যন্ত্রকারী অন্যতম। একটি খেতাবতো তাকে রীতিমতো ঘেরাটোপেই আটকে ফেলেছে, তা হলো ‘রাজনীতির রহস্যপুরুষ।’

অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানকে নিয়ে যে মোহ সৃষ্টি হয়েছিল তাতে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন। এসময় জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে গৃহস্থরা লাউ-কুমড়ার জাংলা ভাঙতে বাধ্য হন। কচি ডগার লাউ-কুমড়ার জাংলা ভাঙতে গিয়ে ভাঙে কৃষকের স্বপ্ন। এ ঘটনা বিশাল ছাপ ফেলে সহজ সরল মানুষের মনে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সুপ্ত আকাঙ্খা যা ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানে জনে জনে কানে কানে বলে বেড়াত, তা আবারো জেগে ওঠে। বৃটিশ-কংগ্রেস-মুসলিম লিগের ষড়যন্ত্রে স্তিমিত হয়ে আসা ভবানী পাঠক, দেবী জয়দুর্গা চৌধুরানী, ফকির মজনু শাহ, নূরউদ্দিন বাকের মুহম্মদ জং, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, সূর্য সেন, প্রীতিলতাদের স্বপ্ন নতুন গতি পায়।

মধ্যবিত্তদের মধ্যে স্বাধীনতার বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা যায় এসময়। এসব উদ্যোগের কোনও কোনোটা সীমাবদ্ধ থাকে দু’একটি বৈঠকের মধ্যে। আবার কোনোটা আটকা পড়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা জালে।

সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ সংক্ষেপে ‘নিউক্লিয়াস’ও স্বাধীনতার এমনি একটি উদ্যোগ, যে উদ্যোগের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড স্বাধীনতার সিংহদূয়ার পর্যন্ত যেতে সক্ষম হয়। নিউক্লিয়াস নেতা সিরাজুল আলম খান হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি।

নিউক্লিয়াস নামটি গোপন থাকলেও তার নেতা সিরাজুল আলম খান কর্মকাণ্ড চালাতেন প্রকাশ্যে, যাতে ছিল নতুনত্ব, ছিল কৌশল। বিশেষ করে নেতা নির্ভরতা কাটিয়ে রাজনীতিকে কর্মী ও জনতা নির্ভর করা- যা নিউক্লিয়াসকে সফলতা এনে দিয়েছে। এই কৌশল, নতুনত্ব বুঝতে যারা অক্ষম তাদের কাছে বিষয়টি জটিল, রহস্যময়। আর যারা বিষয়টিকে সরলভাবে দেখেন এবং বোঝেন, তাদের কাছে জলবৎ তরলং, পানির মতোই সহজ।

তবে, এ বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে মনে রাখা দরকার যে, ‘জনগণ এবং জনগণই হচ্ছে সকল ক্ষমতার উৎস।’ দার্শনিক লালন ফকির আরো সহজভাবে বলেছেন, ‘মানুষগুরু নিষ্ঠা যার, সর্বসাধণ সিদ্ধি হয় তার।’

জনগণ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী নিজের গরজে হাঁটে, এগিয়ে যায়। পথ চলার সময় প্রয়োজনে নেতা সৃষ্টি করে, বাতিল করে। জনগণের এই সৃষ্টি-বাতিল চলতে থাকে আন্দোলনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে। জনগণের চেতনা-মেজাজ বুঝে যারা চলতে পারেন তারা হয়ে ওঠেন জনগণের নেতা। আর জনগণের সাথে চলতে না পারলে নিক্ষিপ্ত হন আস্তাকুঁড়ে। এভাবেই জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করে আর নেতারা সে ইতিহাসে হয়ে ওঠে নায়ক-খলনায়ক। সে রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন। তাইতো তারা সময়ের বরপুত্রও বটে।

১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন সিরাজুল আলম খান। বাবা খোরশেদ আলম খান একজন সরকারি চাকরিজীবী। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন গৃহিনী। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৫৬ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছরেই পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি করা হয়। এসময়ের প্রধান দু’টি ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। এ ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাধীন হলেও ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগকে এবং ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপকে নিকটাত্মীয় মনে করতো। জনাব খান যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে। তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সহসম্পাদক পরে ১৯৬৩-৬৪ ও ১৯৬৪-৬৫তে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২-তে ছাত্রলীগের অপর দুই নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা নিউক্লিয়াস।

আব্দুর রাজ্জাক ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ও পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৫-’৬৬ সালে। কাজী আরেফ আহমেদ মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তারা আঙুল কেটে রক্ত ছুঁয়ে শপথ নেন, যতদিন পূর্ব বাংলা স্বাধীন না হবে ততদিন ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার পিছনে ছুটবেন না তারা।

সে সময়ের রাজনীতি বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, জমিদার ও উঠতি ধনীক শ্রেণি নির্ভর দল কংগ্রেস। একইভাবে তার বিপরীতে একই শ্রেণির মুসলমানদের দল মুসলিম লিগ। মুসলিম লিগের নেতৃত্ব বঞ্চিত নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় আওয়ামী (মুসলিম) লীগ। আর সমাজতন্ত্রের আকাঙ্খা সম্পন্ন মধ্যবিত্ত এবং আওয়ামী লীগের একটি অংশকে নিয়ে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।

এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা স্ব স্ব শ্রেণির মানুষকেই তাদের প্রধান শক্তি মনে করতেন। ছাত্ররা সেখানে সহযোগি শক্তি হিসেবে কাজ করতো, ফুট-ফরমায়েশ খাটতো ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট দলের নেতা হবে বলে।
নিউক্লিয়াস ছাত্রদেরকেই এদেশের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং জাতীয়তাবাদী ধারায় ছাত্রলীগের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। এ কারণে দেখা যায় যে, তাদের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী লীগ যেখানে যে কাজটি করতে ইতস্তত করছে সেখানে দায়িত্ব পালন করছে ছাত্রলীগ। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড স্কুলকলেজেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিশোর ছাত্রকর্মী সংগ্রহ করে তাদের দেখাতে শুরু করে পূর্ব বাংলার স্বাধীকারের স্বপ্ন। মুজিবের ৬ দফার মধ্যে স্বাধীনতার ভ্রূণ খুঁজে পায় নিউক্লিয়াস।

৬ দফাকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে পরিণত করা থেকে ব্যাপক প্রচারের দায়িত্ব পালন করে তারা। ছাত্রলীগের তৎপরতায় তা পরিণত হয় জনগণের কর্মসূচিতে। এই সব ছাত্রকর্মীরাই ১৯৬৯-এ সংগঠন গড়ার লক্ষে যোগাযোগ শুরু করে শ্রমিক এলাকায়। ’৬৯-এর ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন রাজপথ কাঁপিয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটায়। এ আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর নিউক্লিয়াস।

আন্দোলনের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করা হয়। জেলখানা থেকে বেড়িয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। রেসকোর্স ময়দানে তাকে এককভাবে সংবর্ধণা দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ সভায় তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধীতে ভূষিত করা হয়।

এভাবে অন্যান্য নেতাদের ছাপিয়ে বাঙালি জাতির একক নেতায় পরিণত হন বঙ্গবন্ধু। ছাত্রলীগের সহযোগী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শুন্য থেকে বৃহৎ দলে পরিণত হতে শুরু করে।

‘৬৯-এ সিরাজুল আলম খান হয়ে ওঠেন শ্রমিক এলাকার ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।’ তখন সিরাজুল আলম খান শ্রমিক এলাকার যেখানেই গেছেন একদিনের আলোচনায় তাদের টেনে এনেছেন নিজের পক্ষে, গঠন করেছেন শ্রমিকলীগ।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তারা পৌঁছে যায় কৃষক এলাকায়। পাশাপাশি ছাত্র ইউনিয়ন- এদের মধ্যে মেননপন্থিরা পাকিস্তান না পূর্ব বাংলা ভিত্তিক সমাজতন্ত্র- এ দ্বন্দ্বে নিজেদের সংগঠন এমনকি ভাষানী ন্যাপও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর মতিয়াপন্থিরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়। বিরত থাকতে হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং ইশতেহার পাঠের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া থেকে। এতে পাকিস্তানভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে শ্রমিক-কৃষক এলাকায় গড়া সংগঠন বা ঘাঁটিগুলো দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে তা যুক্ত হতে থাকে জাতীয়তাবাদী ধারায়। সংগঠন হারানোর সে দ্বন্দ্বের রেশ এখনো টিকে আছে রাষ্ট্র, সমাজ, এমনকি আমাদের রাজনীতিতেও।

রাষ্ট্র যাদের বিপদজনক মনে করে, সেই সব রাজনৈতিক কর্মীকে আত্মগোপনে বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে হয় কখনো কখনো। অগ্নিযুগের বিপ্লবী এবং কমিউনিস্টদের অনেককেই দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ডে। এ ধলনের পরিস্থিতিতে বিশেষ ওই কর্মীকে রক্ষার জন্য সংগঠন তার কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিত অন্যত্র। ঘোড়াশাল পাটকল এলাকায় কর্মরত কর্মীটিকে নিয়ে যাওয়া হতো খুলনা বা অন্য কোনো এলাকার পাটকলে। পাকশী-শাহপুর এলাকার কৃষককর্মীকে পাঠানো হতো জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে। পাহাড়তলীর কর্মীকে পাঠিয়ে দিতো গোয়ালন্দে বা ঈশ্বরদীতে। এতে প্রচারকাজ এবং সংগঠন ক্ষতিগ্রস্থ হতো, তার অনুপস্থিতিতে ছন্দপতন ঘটতো সংগঠনের বিকাশে।

এই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ হওয়ার কৌশলও পাল্টে ফেলে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের সংগঠন পদ্ধতি বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, কর্মীরা দুই পদ্ধতিতে কাজ করছে। এক ধরণে নেতাকর্মীরা জনসভা, কর্মীসভায় বক্তৃতা করতো। তাদের বক্তৃতা হতো জনগণ ও কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এরা হয়ে উঠতেন জনগণের নেতা, প্রশাসনের চোখে বিদ্যমান রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনকও। রাষ্ট্র তখন এদের বিভিন্ন কায়দায় দমনের চেষ্টা করতো। কখনো কখনো লোভের ফাঁদ পেতে, কখনো বা জেল-জুলুম-হুলিয়া জারি করে।

ফলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে হতো। তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য আইনি লড়াই, কখনো আন্দোলনের চাপে রাখার কৌশল নিত সংগঠন।

অপর ধরণের নেতাকর্মীরা পিছনে থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী সভাগুলোতে অংশ নিত। তারা সাধারণত প্রশাসন এমনকি জনগণের কাছেও থাকতো অপরিচিত। এতে জনগণের সাথে মিশে গিয়ে তারা জনমত যাচাই করতে পারতো এবং সে অনুযায়ী সংগঠনের কৌশল নির্দ্ধারণ হতো। এরা জনগণের নেতা হয়ে উঠতো না, হয়ে পড়তো সংগঠনের নেতাকর্মীদের নেতা। বৈধ সংগঠন ও আন্দোলনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা- এই কৌশলে কাজ করায় নিউক্লিয়াসকে কখনোই রাজনীতির মাঠ থেকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি জনগণ এবং নিউক্লিয়াসের সাথে গড়ে ওঠে এক অপূর্ব যোগাযোগ।

নিউক্লিয়াস জনগণের চেতনা-মেজাজ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করেছে বরাবরই। তাইতো ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার শপথ নিলেও পূর্ব বাংলার স্বাধীকার, সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে হাজির করা ৬দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন নিয়ে হেঁটেছে দীর্ঘদিন। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্র ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার পর জনগণের কাছে যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই- তখনই জনতার আকাঙ্খা অনূযায়ী উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীনতার পতাকা, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে প্রকাশ্যে হাজির করে স্বাধীনতার প্রশ্নটি।

তখন জনতার চাপে পড়ে এক ধারায় মিশে যেতে বাধ্য হয় অন্যরাও। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তখন আর কোনো বিকল্প থাকে না সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া। শুরু হয় জনযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ।

অপরদিকে, ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে পল্টনের জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১দফা কর্মসুচি ঘোষণা করা হয়। এ সভায় বক্তব্য রাখার কারণে সামরিক আদালতে কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেননকে ৭ বছর এবং মাহবুব উল্লাহকে ১ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ... স্বায়ত্বশাসনের কর্মসূচি না দিয়ে কিংবা পাশ কাটিয়ে হঠাৎ করে স্বাধীনতার কর্মসূচি প্রদান করা একটু অগ্রগামী পদক্ষেপ। [বাঙ্গালির জাতিরাষ্ট্র- শামসুজ্জোহা মানিক, পৃষ্ঠা ২৬।]

সেদিনের নায়কদের একালের বক্তৃতা-বিবৃতি, টিভি সাক্ষাৎকার দেখে-শুনে মনে হয়, তাদের মাথা থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বের হয়ে এসেছে, আর কর্মীরা সে অনুযায়ী কাজ করেছে। জনগণ হেঁটে গেছে স্বাধীনতার পথে। কিন্তু এসব বক্তৃতা-বিবৃতি-সাক্ষাৎকারে আস্থা রাখার আগে মনে রাখা দরকার যে, নেতা শব্দটি এখন পণ্যও।

তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করে ধনী হওয়ার মতোই বেড়েছে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব নিজের পকেটস্থ করার প্রবণতা। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আসল ঘটনা তার সম্পূর্ণ উল্টো। বরং জনগণের সবচেয়ে কাছে থাকা কর্মীদের কাছে থেকে এসেছে এসব প্রস্তাব, নিউক্লিয়াস এসব প্রস্তাবের সমন্বয় করে তা যথাসময়ে কাজে লাগিয়েছে।

এ কথার সত্যতা মেলে ওই সময়ের কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকা কয়েকজনের লেখা থেকে। আমরা জানি যে, ষাটের দশকের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শ্লোগান। এই শ্লোগান সৃষ্টির ব্যপারে মোস্তাফা জব্বার (সে সময়ের ছাত্রলীগ কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, আইটি বিশেষজ্ঞ) তার ‘একাত্তর ও আমার যুদ্ধ’ বইয়ের ৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “সেই সময়ে নতুন নতুন শ্লোগান তৈরি করা একটি প্রতিযোগিতার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আবতাব (আবতাব আহমেদ, আততায়ীর হাতে নিহত) চিশতি (শহীদ শাহ হেলালুর রহমান চিশতি) এই প্রতিযোগিতার আগে। আমি দ্বিতীয় সারিতে। আমরা প্রতিদিনই ইকবাল হলে বসে যাচাই-বাছাই করে দেখি যে ছাত্রলীগ কর্মীরা কোন শ্লোগানটি গ্রহণ করছে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় পরের মিছিলে কোন স্লোগানটি বেশি করে দেয়া হবে।”

অন্যান্য নেতাদের ছাপিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতা হয়ে ওঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। এ সম্পর্কে শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন তার ‘মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বইয়ে লিখেছেন, “৩ নভেম্বর ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিধ্বণি’ নামক মাসিক বুলেটিনে তৎকালীন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক সারথী ছদ্মনামে ‘আজবদেশ’ শিরোনামে একটি লেখায় বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নেতার (শেখ মুজিবুর রহমান) নামের পাশে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

রেজাউল হক মুশতাক প্রদত্ত উপাধিটি ছাত্রনেতাদের (ছাত্রলীগ) মধ্যে যথেষ্ট আলোচিত হয়। (এর আগে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণত ‘বঙ্গশার্দুল’ বলে সম্বোধন করা হতো। কিন্তু এই উপাধিটি শেরে-বাংলার সমার্থক হওয়ায় আমরা এটার ব্যবহার নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম।) জনাব তোফায়েল আহমেদ তার দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি রেজাউল হক চৌধুরীর এই লেখা থেকেই গ্রহণ করা হয় বলে বিভিন্ন আলোচনায় স্বীকার করেন।”

পতাকা তৈরির বিষয়ও ঘটেছে একইভাবে। ১৯৭০ সালের ৫-৬ জুন ঢাকার মতিঝিলের হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এ উপলক্ষে অধিবেশনের পরদিন ৭ জুন শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভায় মফস্বল থেকে আসা কাউন্সিলরদের সামনে শো-ডাউনের সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিরা, যে মহড়ায় ফুটে উঠবে রণভঙ্গী। এজন্য গড়ে তোলা হয় জয় বাংলা বাহিনী। ইকবাল হলের খেলার মাঠে শুরু হয় এর মহড়া। শো-ডাউন আরো জাঁকজমকপূর্ণ করতে নেতাকর্মীরা একের পর এক যুক্ত করতে থাকে, ব্যাজ, ক্যাপ, ব্যান্ডপার্টি ইত্যাদি।

এভাবেই চলে আসে ৬ জুন। বিকেলে চূড়ান্ত মহড়া দেয়া হয়। এরপরে বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যপারে মনিরুল ইসলাম তার ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ বইয়ে বলেছেন, “পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত ও পতাকা তৈরি পর্যন্ত কাজী আরিফ (আরেফ) ছাড়া উচ্চ পর্যায়ের কারো অনুমতি গৃহিত হয়নি। ... পতাকা তৈরির কথা জানিয়ে তার (সিরাজুল আলম খান) অনুমতির জন্য আবেদন করা হলো। ... তিনি সমস্ত কিছু শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যে নাম দিয়েই পতাকা প্রদর্শণ করা হোক না কেন, তাকে জনগণের ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বলে ভেবে নিতে কোন বাধা থাকবে না। ... অনেক আলোচনার পর তিনি লাল বৃত্তের মাঝে পূর্ব বাংলার মানচিত্র এঁকে প্রদর্শণের পক্ষে মত দিলেন।” এভাবেই কর্মীদের হাতে তৈরি হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

একইভাবে জনগণ সংলগ্ন কর্মীদের কাছ থেকেই আসে স্বাধীনতার ইশতেহারও। ধীরে ধীরে সাধারণ কর্মী তথা জনগণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বাড়তে থাকে, জনগণ হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। জনে জনে, শতে শতে, হাজারে হাজারে জনতা কারো নির্দেশ বা পরামর্শে নয়, নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। শুরু হয় জনযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর ছত্রছায়ায় অনেকেই যুক্ত হন স্বাধীনতা যুদ্ধে। এসব শক্তির মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ, ‘বামপন্থিদের একাংশ ছাড়াও বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন, প্রতিবেশি দেশ ভারত, পাকিস্তানের ভেঙ্গে পড়া আমলাতন্ত্রের একাংশ, স্বাধীনতা বিরোধীদেরও কেউ কেউ। ছাত্র-যুব শক্তিতো আছেই। এদের বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্ন।

সিরাজুল আলম খান মনে করতেন, যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে বৃটিশ-পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো। সেখানে গড়ে উঠবে গণবাহিনী (পিপলস আর্মি), গণপ্রশাসন, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ব্রিগেড ইত্যাদি। যে রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা করবে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র সমাজতন্ত্র। এসব তথ্য পাওয়া যায় বিএলএফের দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে।

কিন্তু তার হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ‘যে স্বাধীনতা যুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার কথা, তা হয়না। ঔপনিবেশিক কাঠামোর অস্তিত্ব বাঁচিয়ে সীমিত যুদ্ধে আটকে যেতে হয়।’ (৭ মে, ’৮৬- নির্বাচনে জাসদ কেন অংশগ্রহণ করতে পারলো না, পৃষ্ঠা ২) অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন গণনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণনায়কেরা যখন জনসমক্ষে উপস্থিত হন, তখন জনতার মধ্যে নানা ধ্বণি ওঠে। তিনি সে সব ধ্বণি মনোযোগ দিয়ে শোনেন, জনতার ভাবভঙ্গী দেখেন; উপস্থিত জনতা কী চায় তা বোঝার চেষ্টা করেন। যখন ভাষণ দেন, জনতার কথাগুলো বলার চেষ্টা করেন নিজের বাণীতে। গণনায়ক হয়ে ওঠেন জনতার মুখপাত্র।

বঙ্গবন্ধুও দেশে ফিরে এসে জনতার মনোভাব, ভাবভঙ্গী বোঝার চেষ্টা করেন। বোঝার চেষ্টা করেন দেশের ভিতরে অবস্থিত বিভিন্ন শক্তি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকেও। প্রায় সাত মাস বঙ্গবন্ধু নিরপেক্ষ থাকেন, বিভিন্ন শক্তির ভারসাম্য বোঝার চেষ্টা করেন। সবাইকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা ফুটে ওঠে তার কথাবার্তায়। এর মধ্যেই পাকিস্তানের ভেঙ্গে পড়া আমলাতন্ত্রের কাঠামো (বাংলাদেশ অংশের) কিছুটা হলেও জোড়া লাগানো সম্ভব হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সবচেয়ে উদ্যোগী শক্তি ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দুই ভাগই ২১ জুলাই ১৯৭২ সালে প্রস্তুতি নেয় সম্মেলনের।

সম্মেলনের আগের দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন। সম্মেলনের দিন তিনি শেখ ফজলুল হক মনি সমর্র্থিত ছাত্রলীগের সংখ্যালঘু অংশকে সমর্থন দিয়ে নিজের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ত্যাগ করেন সিরাজুল আলম খান সমর্থিত ছাত্রলীগের সংখ্যাগুরু অংশকে।

ইতিমধ্যেই সিরাজুল আলম খানের দীর্ঘদিনের সহকর্মী নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আব্দুর রাজ্জাক দ্বিমত পোষণ করে সরে গেছেন। আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ বিএলএফের প্রধানদের মধ্যে ঠাঁই না পেয়ে পিছিয়ে পড়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা, সিরাজুল আলম খানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বটবৃক্ষ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের ছায়া তার উপর থেকে সরে গেছে। তিনি হয়ে পড়েছেন সঙ্গীহীন, একা। তিনি বুঝতে পারেন যে, আজীবন বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেলেও রাজনৈতিক সহযোগিতা আর পাবেন না। এদিকে, ছাত্রলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে ঘিরে ধরে তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গুরু সিরাজুল আলম খানকে। এই ছাত্রনেতারা অনেকেই ততদিনে রাজনীতিকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। তাদের টিকে থাকার জন্য ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল উপলক্ষে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদের ভূমিকাঃ ‘৭২ থেকে ‘৯২’ (খসড়া) পুস্তিকায় লেখা হয়েছে ‘জাসদ একটি আন্দোলনের নাম।... নেতৃত্বের প্রশ্নে জলিল-রবের নামেই পরিচিত ছিল। সংগঠনের নেপথ্য নেতৃত্ব ছিল সিরাজুল আলম খানের হাতে।’ এভাবেই শুরু হয় সিরাজুল আলম খানের নবযাত্রা। (প্রথম কিস্তি শেষ। আগামী কিস্তিতে সমাপ্য)

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও ছড়াকার

নিউজওয়ান২৪.কম/একে