NewsOne24

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স: যে দক্ষতা আপনাকে নিয়ে যাবে বহুদূর! 

অসম্পাদিত ডেস্ক

নিউজওয়ান২৪

প্রকাশিত : ০৭:৩৪ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সোমবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি


১৯৯০ সালে EI বা “ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স” শব্দটি গবেষক জন মায়ার এবং পিটার স্যালোভি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু পরে ১৯৯৫ সালে মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গোলম্যান তার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ে ব্যাবহার করেন এবং তা তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং ঐ বইটি সে সময়ের “ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের” উপর লিখা সর্বাধিক বিক্রিত বই এর খাতায় নাম উঠে। গোলম্যান বইটিতে EI বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সকে দক্ষতা এবং বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন যা নেতৃত্বের কর্মক্ষমতাকে চালিত করে। সহজ ভাবে বললে বিষয়টা এমন যে আপনি আপনার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর কতোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন বা কিভাবে সামলাচ্ছেন তারই একটি স্কীল হল ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (EI)।

একটি উধারণ দেয়া যাকঃ ধরুন আপনি আপনার পরিবার পরিজন বা বন্ধুদের নিয়ে কোন এক ব্র্যান্ড এর রেস্টুরেন্টে রাতের বেলা খাবার খেতে গিয়েছেন। এখন খাবার পরিবেশনের পর একটি তেলাপোকা আপনার খাবারে দেখতে পেলেন। এখন আপনার কি করা উচিৎ? ঠিক ঐ মুহূর্তে আপনার আবেগ এবং বুদ্ধিমত্তার সংমিশ্রণে যে সিদ্ধান্তে আপনার মন আপনাকে পৌঁছে দিবে তাকেই বলা হয় ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। ঐ মুহূর্তেকে আপনি অনেক ভাবেই ডিল করতে পারেন। আপনি রেগে যেতে পারেন, ওয়েটারকে ডেকে বকাবকি করতে পারেন বা ম্যনেজারকে ডেকে কথা শুনাতে পারেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারেন, যেন কেউ ঐ রেস্টুরেন্টে না যায়। এইতো! কিন্তু ঘটনাটা চাইলেই অন্যভাবেও আপনি কন্ট্রোল করতে পারেন। যেমন, ঐ মুহূর্তে মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা,  রেস্টুরেন্টের ম্যনেজার এর সাথে লজিকালি কথা বলা, হাইজিন এবং ব্র্যান্ড ভালু নিয়ে কথা বলা এবং পরিস্থিতিকে একটা নিগসিয়েশনের টেবিলে নিয়ে আসা। যেন দুই পক্ষেইর একটিই উইন-উইন সিচুয়েশন তৈরি করা যায়। তার মানে আপনি আপনার ইমোশন এবং ইন্টেলিজেন্স এই দুই এর সংমিশ্রণে কঠিন একটি মুহূর্তকে সামলে নিলেন। তবে কথা থাকে যে, এই ইন্টেলিজেন্স আপনি একদিনেই অর্জন করতে পারবেন না। আপনাকে দৈনন্দিন চর্চার মাধ্যমে এই স্কীল আয়ত্তে আনতে হবে।   

কিভাবে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের চর্চা করব?

৪ টি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের চর্চার জন্য।

১। নিজের আত্মসচেতনতা (Self-Awareness)ঃ আত্মসচেতনতার (Self-Awareness) অর্থ হল ‘একজনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, পছন্দ, সম্পদ এবং অন্তর্দৃষ্টিগুলি জানা’। যদি আমরা জানি যে আমাদের অভ্যন্তরীণ পছন্দগুলি ঠিক কী, তাহলে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যদি আমরা জানি যে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার প্রতি আমাদের সংবেদনশীল আবেগ গুলো কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তাহলে আমরা ঐ আবেগীও প্রতিক্রিয়া গুলোকে নিয়ে কাজ করতে পারি বা ঐ প্রতিক্রিয়া গুলো থেকে কিভাবে অসংবেদনশীল হওয়া যায় তার জন্য চেষ্টা করতে পারি। যেমন মনে করুন, আপনি হয়ত সামান্যতেই রাগ বা অভিমান করেন । একবার কোন কিছুতে মন খারাপ হলে আর কোন ভাবেই মন ভাল হয় না। আপনাকে ঠান্ডা মাথায় খুঁজে বের করতে হবে কি কি ঘটনা আপনার মনকে খারাপ করে দিচ্ছে আর কি কি ঘটনা আপনার মনকে ভাল রাখছে। সেই অনুযায়ী আপনাকে যেকোন পরিস্থিতিকে আরও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাবেই পরিবর্তন আসবে।

২। নিজেকে ম্যানেজ করা (Self-Management)ঃ স্ব-ব্যবস্থাপনা বা Self-Management হল একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নিজের লাইফ স্টাইল এবং আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগের অনুশীলন। এটি এমন একটি পরিকল্পনার উৎস, যা একজনের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নিজেকে সেই দিকে পরিচালিত করবে। অলসতাকে সীমিত করা, সুস্থ থাকার জন্য ব্যয়াম করা এবং হেলদি খাবার খাওয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া সেই তালিকায় স্থান পেতে পারে অনায়াসে। তালিকা বা পরিকল্পনাকারীর মতো টুল ব্যবহার করে অরগানিজড থাকা, এবং অন্যের কথা শুনা এবং সহানুভূতিশীল হয়ে সম্পর্ক বজায় রাখাই স্ব-ব্যবস্থাপনার উদাহরণ। নিজেকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে হবে যে আপনি কিছু অর্জন করতে চান নাকি চান না। আপনি কোন লক্ষ্য অনুসরণ করছেন কিনা? বা সেই পথে আপনার কোন বাধা রয়েছে  কিনা? আর যদি কোন বাধা থেকে থাকে তাহলে আপনি সেই বিষয় নিয়ে কোন কাজ করছেন কিনা। বা কীভাবে আপনি সেই পথে নিজেকে পরিচালনা করতে পারেন সেই বিষয়ে নিজের জ্ঞান বাড়ান। আপনার এই প্রশ্নগুলিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি কৌশল তৈরি করতে হবে। আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে কিভাবে আপনার আচরণ আপনার চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলিকে প্রভাবিত করে। সেইসাথে আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয়গুলি বিবেচনা করা যা পছন্দসই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে। সময়ানুবর্তীতা, অন্যের সাথে কথা বলা বা কমিউনিকেট করা, পরিকল্পনা করা, নিজের জন্য লক্ষ্য সেট করা, নিজের বিষয়ে আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়া এবং নিজ লক্ষে নিজেকে পরিচালিত করবার জন্য নিজেকে মটিভেট করা। বেশিরভাগ লোকের লক্ষ্য থাকে তারা পৌঁছাতে চায়, কিন্তু মূল সমস্যা হল অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন। যেমন, যেমন একটি ভ্রমণ বা ছুটির জন্য অপেক্ষা করা। এটা মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং তার নিজস্ব স্ব-ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ায়। মনে রাখতে হবে নিজের লক্ষে পৌঁছানোর জন্য নিজেকে মোটিভেট রাখতে হবে এবং চর্চার মাধ্যমে নিজের দুর্বলতা নিজে কাজ করতে হবে তবেই সঠিক ভাবে নিজেকে ম্যানেজ করা যাবে।

৩। অন্যদেরকে বা সমাজকে বোঝা (Others or Social Awareness)ঃ সামাজিক সচেতনতা বা সমাজকে বোঝা হচ্ছে সামাজিক যোগ্যতার একটি পূর্বশর্ত এবং ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এর একটি মূল উপাদান। আপনার যদি সামাজিক সচেতনতার অভাব থাকে তবে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে আপনি খুব কমই সামাজিক পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। বা এমন হতে পারে যে আপনি প্রায়শই ভুল কথা বলেন, বা আপনি বুঝতে পারেন না কেন লোকেরা আপনার কথাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু আপনি হয়ত জানেনইনা যে অনুশীলনের মাধ্যমে, আপনি আপনার সামাজিক সচেতনতা উন্নত করতে পারেন। আপনার সামাজিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করা সম্ভবত আপনাকে আপনার অন্যান্য সমস্ত সামাজিক এবং সম্পর্কের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে। যেমন, সহমর্মিতা, এটি সামাজিক সচেতনতার একটি বড় উপাদান। আমরা সামাজিক প্রাণী, যারা এমন একটি বিশ্বে বাস করি যেখানে সংযোগ এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সাফল্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষের অনুভূতি বোঝার গুরুত্বকে জোর দেয়। যখন আমাদের সামাজিক সচেতনতার অভাব হয়, তখন আমাদের জীবন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং এবং স্ট্রেস্ফুল হয়ে উঠতে পারে। এমন নয় যে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের সমাজে আকর্ষণীও করে তুলবে; বরং, এর সহজ অর্থ হল আমরা আমাদের পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী পুরুষ বা মহিলার সাথে আরও ইতিবাচক এবং অর্থপূর্ণভাবে কথা বলতে পারব। আমরা তাদের সমস্যাগুলি এবং কী তাদের খুশি করে সে সম্পর্কে আরও ভালভাবে বুঝতে পারব। এখানে আমাদের বুজতে হবে, আমরা যখন কোন ঘটনা দেখি তখন প্রত্যেকে তার নিজের মত করে অনুধাবন করে। আপনি দেখবেন একই ঘটনা এক একজন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলবে এবং ভিন্নভাবে নিজ নিজ মত প্রকাশ করবে। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে সঠিক। এখানে কেউই ভুল নয়। আপনাকে তার মত করে ভাবতে শিখতে হবে, আরেকজনের মতের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হবে। তাবেই সমাজকে বুঝা যাবে।

৪। সম্পর্ক বা সমাজকে ম্যানেজ করা (Relationship or Social Management)ঃ রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট বলতে বোঝায় আমাদের স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করার, অন্যদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা, অন্য সংস্কৃতির লোকদের সাথে সংযোগ স্থাপন, টিম ওয়ার্ক ভালোভাবে করা এবং যেকোন কনফ্লিক্ট বা দ্বন্দ্ব পরিচালনা করার ক্ষমতা অর্জন করা। সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এর অন্য তিনটি ক্ষেত্র ব্যবহার করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনার টিম লিড রাহিম (সদ্ম নাম) । তিনি টিমের কলিগদের আবেগ পড়তে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারদর্শী, এমনকি সে রাজি না হলেও। একজন নেতা হিসাবে, তার দরজা সর্বদা খোলা থাকে এবং তিনি সহকর্মীদের এবং অন্য কর্মীদের কাছে এটি স্পষ্ট করে দেন যে তারা যে কোনও সময় তার সাথে কথা বলতে পারেন। সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি রাহিমের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স কম থাকে, তাহলে তিনি লোকেদের ছোট করে কথা বলতে পারেন বা তার ইতিবাচক হতে অসুবিধা হতে পারে। তিনি একজন ভাল টিম প্লেয়ার হিসাবে বিবেচিত হতে পারবেন না, যা তার সম্পর্ক পরিচালনা করার ক্ষমতার অভাব দেখা দেবে। কিন্তু কিভাবে আমরা এই সম্পর্ক বা সমাজকে ম্যানেজ করতে পারি? প্রথমত স্বচ্ছ হওয়া, অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং যেকোন সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল থাকা। সেই সম্পর্ক পরিচালনার জন্য যদি কোন কৌশল এর প্রয়োজন পরে তবে তাও গ্রহন করা । সহকর্মী এবং কর্মচারীদের সত্যিকার অর্থে শুনতে এবং বোঝার জন্য সময় নেওয়া যেন সম্পর্ক পরিচালনার দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করে। অনেকে আপনার সাথে গল্প করতে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে যদি আপনি মন্তব্যগুলি গ্রহণ করতে এবং বুজতে আগ্রহী হন।

পরিশেষে বলতে চাই, আবেগগত বুদ্ধিমত্তা এমন একটি বিষয় যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। আত্ম-ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী মস্তিষ্কের অঞ্চলটি বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পরে পরিপক্ক হতে থাকে। কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উচ্চ মানসিক বুদ্ধিমত্তা (EI) লোকেদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং ভাল বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদিও আবেগগত বুদ্ধিমত্তা কারো কারো কাছে স্বাভাবিকভাবেই আসে বলে মনে হতে পারে তবে, আমরা যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক থাকি তাহলে আমরা আমাদের মানসিক বুদ্ধিমত্তা চর্চার মাধ্যমে বাড়াতে পারি।

লেখক- তানভীর মোহাম্মাদ নোমান

নিউজওয়ান২৪.কম/আরএডব্লিউ