NewsOne24

সুন্নাত ও বিজ্ঞানের আলোকে মিসওয়াক

ধর্ম ডেস্ক

নিউজওয়ান২৪

প্রকাশিত : ১১:৪১ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

মিসওয়াককারীর মুখস্ত শক্তি বেড়ে যায়-প্রতীকী ছবি

মিসওয়াককারীর মুখস্ত শক্তি বেড়ে যায়-প্রতীকী ছবি


‘মিসওয়াক’ ইসলামী পরিচ্ছন্নতার অন্যতম একটি বিষয়। যা মানুষের আত্নিক ও শারীরিক উভয় দিকের উপকার সাধন করে।

এ ছাড়াও মিসওয়াক করা রাসূল (সা.) এর সুন্নাত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি সুন্না, যা তিনি নিয়মিত করতেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে আমাদের মুসলিমদের মাঝে এই সুন্নাতটি মৃতপ্রায়, যা মোটেই কাম্য নয়। কারণ এতে ইসলামীক গুরুত্ব ও ফজিলত এবং বৈজ্ঞানিক উপকারিতা বিদ্যমান। নিম্নে সুন্নাত ও বিজ্ঞানের আলোকে মিসওয়াকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

মিসওয়াক কি?

মিসওয়াক হলো আরবি শব্দ, যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘দাঁতন’। সাধারণত মিসওয়াক বলতে আমরা বুঝি, দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করার জন্য যে বিভিন্ন গাছের ডাল ও কাষ্ট টুকরা ব্যবহার করা হয় তাই মিসওয়োক। আরবদেশে সাধারণত দাঁত পরিষ্কার ‘স্যালভাদরা পারসিকা’ নামক গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা হতো। যাকে আরবিতে ‘আরাক’ গাছও বলা হয়। তবে মিসওয়াক হিসেবে পিলু, নিম, বাবলা,কানির, জায়তুন, জাতীয় তেঁতো, লবনাক্ত গাছের নরম আশঁযুক্ত ডাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ সব গাছ ছাড়াও বিভিন্ন গাছের ডালকে মিসওয়াক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সুন্নাতের আলোকে মিসওয়াক

মিসওয়াকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: ইসলামে মিসওয়াকের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (সা.) তাঁর অসংখ্য হাদিসে মিসওয়াকের ব্যাপারে গুরুত্বরোপ করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে এর প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান করেছেন। নিম্নে মিসওয়াকের গুরুত্বের ব্যাপারে কতিপয় সহিহ হাদিস পেশ করা হলো-

বিখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বরেছেন, আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করতাম তাহলে তাদেরকে প্রতি ওয়াক্ত সালাতের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম। (বুখারী হাদিস: ৮৮৭, ৭২৪০ ও মুসলিম হাদিস: ২৫২)।

আয়িশাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, দশটি কাজ ফিতরাতের (প্রকৃতির) অন্তর্ভূক্ত ‘গোঁফ খাটো করা, দাড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা,আঙ্গুলের গিরাগুলো ঘষে মেজে ধৌত করা, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাভীর নিচের লোম মুড়িয়ে ফেলা এবং মল-মূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহার করা। যাকারিয়া বলেন, মুসআব বলেছেন, দশম কাজটি আমি ভুলে গেছি, তবে আমার ধারণা তা হবে কুলি করা। (মুসলিম হাদিস: ৫১১,ই.ফা.)।

শুরাইহ্ বলেন আমি আয়িশাহ্ (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম রাসূল (সা.) যখন গৃহে প্রবেশ করতেন তখন কোন কাজটি সর্বপ্রথম করতেন? আয়িশাহ্ (রা,) বললেন মিসওয়াক করতেন। (মুসলিম হাদিস: ৪৯৮,ই.ফা.)।

আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি মিসওয়াক করার ব্যাপারে তোমাদেরকে অত্যাধিক উৎসাহিত করেছি। (সুনান আন নাসায়ী, হাদিস: ৬)।

মিসওয়াকের উপকারিতা

মিসওয়াকের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। যেমন: রাসূল (সা.) এর বানী, ‘আয়িশাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিক রাসূল (সা.) বলেছেন মিসওয়াক মুখ পবিত্র ও পরিস্কার রাখে এবং তার দ্বারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। (সুনান আন নাসায়ী, হাদিস: ৫)।

এছাড়াও মিসওয়াকের মাধ্যমে যেসব উপকারিতা পাওয়া যায়  তা হলো: (১) রাসূল (সা.) এর সুন্নাত আদায় হয়। (২) মিসওয়াককারীর মুখস্ত শক্তি বেড়ে যায়। (৩) শয়তান অসুন্তুষ্ট হয়। (৪) প্রশান্তি ও স্বস্তি অর্জিত হয়। (৫) মুখ পরিষ্কারর ও পরিচ্ছন্ন হয়। (৬) মাথা ব্যথা দূর হয়। (৭) ক্ষতিগ্রস্ত চোখের রোগ দূর হয়। (৮) প্লেগ রোগ দূর হয়। (৯) মুখ সুগন্ধি যুক্ত হয়। (১০) মাড়ি শক্ত হয়। (১১) কফ কেটে যায়। (১২) ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ হয়। (১৩) মুখের লালাস্রাব বৃদ্ধি হয়। (১৪) দাঁতের টিস্যু নিরাময় নিয়ন্ত্রণ করে।

বিজ্ঞানের আলোকে মিসওয়াক

(ক) মিসওয়াক হলো জীবাণুনাশক: মিসওয়াক জীবাণু ধ্বংসকারী এন্টিসেপ্টিক এর কাজ করে এবং এটা মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। নতুন গবেষণা অনুযায়ী জানা যায়, মুখে এমন কিছু জীবাণু সৃষ্টি হয়, যা প্রচলিত ব্রাশ এবং পেষ্ট দ্বারা দূর হয় না। সেগুলোকে শুধুমাত্র মিসওয়াকের মাধ্যমেই ধ্বংস করা যেতে পারে। তাই নিয়মিত মিসওয়াককারীর বিভিন্ন রোগ তেকে বেঁচে থাকেন।

(খ) মিসওয়াক ও মৃতের মস্তিষ্ককের সুস্থতা: চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, মিসওয়াক ব্যবহারের দ্বারা মৃতের মস্তিষ্ককের সুস্থতা অটুট থাকে। মিসওয়াক ব্যবহার না করলে মুখে ব্যাকটিরিয়া জন্মায়, এবং তা থেকে মাড়ি ও চোয়ালে পুঁজ সৃষ্টি হয়।, যা মস্তিষ্কের রোগের কারণ। এবং এর ফলে হৃদরোগও হয়ে থাকে।

(গ) মিসওয়াক ও গলানালী: যেসব রোগীর গলানালী আক্রান্ত হয় তারা সাধারণত টনসিলের রোগী। এসব রোগী নিয়মিত মিসওয়াক করলে সুস্থ হয়ে যায়। যারা নিয়মিত মিসওয়াক ব্যবহার করে তাদরে  টনসিলের রোগ খুবই কম হয়। অনুরুপভাবে,যাদের গলানালী বড় হয়ে যায় তারাও নিয়মিত মিসওয়াক করার দ্বারা উপকৃত হতে পারে।

(ঘ) মিসওয়াক ও মুখের  ঘা: কখনো কখনো গর্মি, দুর্গন্ধ এবং জীবাণুর কারণে মুখের ভেতর ফোঁড়া হয়ে ঘা এর সৃষ্টি হয়। এগুলো কখনো প্রকাশ পায় আবার কখনো প্রকাশ পায় না, এটা খুবই কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর। এর জীবাণু পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ে মুখকে আক্রান্তস্থলে পরিণত করে। ফলে খাবার গ্রহণ মুশকিল হয়ে পড়ে। প্রতিদিন নিয়মিত মিসওয়াক করলে এবং লালা মুখের ভেতর উত্তমরুপে মিশে গেলে এ রোগ হয় না।

(ঙ) মিসওয়াক ও দাঁতের স্বাস্থ্য: মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকমের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে থাকে। আর এ সব খাবারের ছোট-ছোট কণা দাঁতের ফাঁকে জমতে থাকে, যা সাধারণত কুলি করার দ্বারা দূর হয় না। ফলে মুখ ও দাঁতের বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু নিয়মিত মিসওয়াক করলে এরুপ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

(চ) মিসওয়াক ও চোখ: মানুষের অমূল্য সম্পদ হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। দাঁতের অপরিচ্ছন্নতা চোখের বিভিন্ন রোগের কারণ। কেননা দাঁতের সঙ্গে চোখের বিশেষ সংযোগ রয়েছে। তাই দাঁত আক্রান্ত  হলে  চোখও আক্রান্ত হয় এবং দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে,যার  দরুন এক সময়  চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু নিয়মিত মিসওয়াক করলে এ ধরনের রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

(ছ) মিসওয়াক ও কান: কিছু রোগী আবার এমন আছে যারা কখনো কখনো কানের প্রদাহ, পুঁজ ও ব্যথায় কাতর থাকে। কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, দাঁত ও মাড়ির সমস্যার কারণে এরুপ হয়েছে। যখন দাঁত ও মাড়ির চিকিৎসা এবংনিয়মিত তাজা মিসওয়াক করা হয় তখন কানও ভালো হয়ে যায়।

(জ) মিসওয়াক ও পাকস্থলী: বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রায় ৮০ শতাংশ রোগ পাকস্থলী ও দাঁতের সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশেষত; বর্তমানে প্রতি তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন পেটের রোগে আক্রান্ত। মিসওয়াক না করার ফলে মুখে, দাঁতে ও মাড়িতে জীবাণু জন্মায় এবং খাওয়ার সময় তা পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। ফলে পাকস্থলী ও জঠরের রোগ সৃষ্টি হয়। নিয়মিত মিসওয়াক করলে এধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

(ঝ) মিসওয়াক ও কফ-কাশি: এমন রোগী যার কফ আটকে গেছে, সে যদি মিসওয়াক করে তবে ওই কফ ভেতর থেকে বের হতে শুরু করে। প্যাথলজিস্টদের মতে, সার্বক্ষণিক সর্দির জন্য মিসওয়াক প্রতিষেধকের কাজ করে। নিয়মিত মিসওয়াকের ফলে সর্দি, কাশি ও কফ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

(ঞ) মিসওয়াক ও হার্টের ঝিল্লি: প্রখ্যাত ডাক্তার এস এম ইকবাল বলেছেন যে, একবার তার নিকট একজন রোগী এসেছিল যার হার্টের ঝিল্লিতে পুঁজ ছিল। বিভিন্ন চিকিৎসার পরও সুস্হ হচ্ছিল না। সর্বশেষ হার্টের অপারেশন করে পুঁজ বের করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পুঁজ আবার জমে গেলে অবশেষে রোগী হতাশ হয়ে সেই ডাক্তারের নিকট আসলো। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন যে তার দাঁতের মাড়িতে পুঁজ আছে এবং এ পুঁজই তার হার্টে প্রভাব ফেলছে। তখন ডাক্তার তাকে দাঁত ও মাড়ির চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত মিসওয়াক করতে বললেন, যার ফলে তিনি আরোগ্য লাভ করলেন।

টুথব্রাশ নাকি মিসওয়াক?

বিভিন্ন পরীক্ষা ও অভিজ্ঞা থেকে এ কথা প্রমাণিত, যে টুথব্রাশ একবার ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে জীবাণু জমা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পানি দ্বারা পরিষ্কার করলেও জীবাণু ধ্বংস হয় না বরং বারতেই থাকে। আর এই ব্রাশ বারংবার ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হওয়ার আশু সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া ব্রাশ এর ব্যবহারে দাঁতের ওপরের ঔজল্ল্য এবং সাদা আবরণ উঠে যায়। ফলে মাড়ির মাঝের ফাঁকও বেড়ে যায় এবং মাড়ির স্থান ছুটে যেতে থাকে, যার কারণে সে ফাঁকা স্থানে খাদ্য আটকে থাকে এবং দাঁতে বিভিন্ন ধরনের রোগের সংক্রামণ দেখা দেয়।

পক্ষান্তরে মিসওয়াক, প্রথমত রাসূল (সা.) এর সুন্নাত যা সম্পাদনে নেকীর অধিকারী হওয়া যায় পাশাপাশি মিসওয়াকে ভেষজ জাতীয় পদার্থ থাকে যা দাঁতের জন্য খুবই উপকারী এবং সব ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত এবং কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) তার ‘মৌখিক পরিচ্ছন্না’ বিষয়ক শীর্ষক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলেছে যে, ডেন্টাল স্বাস্থ্য বিধির ক্ষেত্রে মিসওয়াক ব্যবহার খুবই উপযোগী।

পরিশেষে সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দের প্রতি উদাত্ত আহ্বান এই যে, আধুনিক বিজ্ঞানের নব-আবিষ্কারের ফলে যে সুন্নাত প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে বিশ্ব মানবতার কল্যাণার্থে অবতীর্ণ, তা বর্তমানে প্রযুক্তির ছোবলে দংশিত এবং আমলের ক্ষেত্রে অবহেলিত।

সুতরাং আসুন এখন থেকেই ইসলামের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র যে কোনো বিধানই হউক না কেন তা তুচ্ছ মনে না করে গুরুত্ব সহকারে পালন করার চেষ্টা করি। যেন ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ উন্মেচিত হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড