NewsOne24

৭১ এর ১৫ ডিসেম্বর: মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস

নিউজ ডেস্ক

নিউজওয়ান২৪

প্রকাশিত : ০৯:৪১ এএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ রোববার

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে চলছিল মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস।- প্রতীকী ছবি

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে চলছিল মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস।- প্রতীকী ছবি

৭১ এর ১৫ ডিসেম্বর। এই দিনে চারদিক থেকে পরাজিত হতে হতে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝে ফেলে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তারা শুধু নিশ্চিত হতে চাইছিল তারা যখন আত্মসমর্পণ করবে তখন তাদের হত্যা করা হবে না। 

কেননা মার্কিন ৭ম নৌবহরকে মোকাবিলা করার জন্য ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরির ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর মার্কিন রণতরি ৭ম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। পাকিস্তানের মনে যুদ্ধে সাহায্য পাবার যেটুকু আশা ছিল সেটাও এর সঙ্গে শেষ হয়ে যায়।

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে চলছিল মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস। অসংখ্য নদীনালা, খালবিলসহ নানা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলায় অবরুদ্ধ ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ক্রমাগতভাবে ভারতীয় মিগের একের পর এক বোমাবর্ষণ ও স্থল পথে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে দখলদার বাহিনীতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির দেয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে জেনারেল মানেক শ হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেন যে, শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হবে না।

এসময় প্রস্তাবের প্রতি মিত্রবাহিনীর আন্তরিকতার নিদর্শন হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে বলে পাকিস্তানি জেনারেলকে জানিয়ে দেয়া হয়। এমনকী আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী কোনো প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না বলেও পাকিস্তানি জেনারেলকে আশ্বস্ত করা হয়। তবে, সেই সঙ্গে পাকিস্তানি জেনারেলকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে এও বলা হয় যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। জেনারেল নিয়াজী তাত্ক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে পাকিস্তান হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দেন যে, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য যে সব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেয়া যেতে পারে। নিয়াজি তাত্ক্ষণিকভাবে তা ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক শকে অবহিত করেন।

এদিনটি মূলত দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন-ক্ষণ নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়।

বিকেলে যৌথবাহিনী বিনা প্রতিরোধে সাভার প্রবেশ করে। সাভারের পাকিস্তানী বাহিনী পিছু হটে এসে রাজধানীর প্রবেশ-পথ মীরপুর ব্রীজের ওপর প্রতিবন্ধক গড়ে তোলে।

রাতে যৌথ বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরীয়া বাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। রাত দু’টায় মীরপুর ব্রিজের কাছে যৌথবাহিনী পাক সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যৌথবাহিনী ব্রিজ দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ব্রিজের ওপাশ থেকে পাকবাহিনী মুহুর্মূহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় যৌথবাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম পাড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত তুমুল যুদ্ধ চলে।

চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে আরো কয়েকটি স্থান হানাদার মুক্ত করে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম রক্ষাব্যুহ ভাটিয়ারীতে আক্রমণ চালায়। সারারাত মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলে। ভাটিয়ারি থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রাস্তার রাস্তার যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

যৌথবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হয়। রাতে তারা চারদিক থেকে রংপুর শহর ঘিরে ফেলে। যৌথবাহিনীর পরের দিন রংপুর সেনানিবাসে আক্রমণ করার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ-বিরতির ঘোষনা হওয়ায় তার আর প্রয়োজন হয়নি।

ফরিদপুর অঞ্চলে যৌথবাহিনী কামারখালীর পাকঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে অবস্থান ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে পালাতে থাকে। যৌথবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে স্বেচ্ছায় শত্রুসৈন্য যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী অফিসারদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল ছিলেন।

১৯৩৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার খয়েরপুর গ্রামে ডা. আলীম চৌধুরীর জন্ম। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে ডা. আলীম ছিলেন দ্বিতীয়। নিজের জীবন তুচ্ছ করে তিনি মুক্তিযেদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর হানাদারদের সহযোগী সংগঠন আলবদররা তাঁকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। চক্ষু চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর দুই চোখ তারা উপরে ফেলে। তাঁর বাড়িতে আশ্রিত মাওলানা মান্নান তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

ক’দিন বিরতির পর সকালে ঢাকার আকাশে আবার দেখাদেয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমারু বিমানগুলো। বেলা ১১ টায় গভর্নর ডা. মালিক তার মন্ত্রিপরিষদ ও সামরিক বেসামরিক উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করার মুহূর্তে ভারতীয় বোমারু বিমানগুলো উড়ে এসে গভর্নর হাউজের ওপর রকেট হামলা করে। ডা. মালিক প্রাণ বাঁচাবার জন্য ট্রেঞ্চে গিয়ে আশ্রয় নেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানী কমান্ডারদের আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মত নির্দেশ দেন। জেনারেল মানেকশ তার নির্দেশে বলেন, ‘আমি আবার বলছি, আর প্রতিরোধ করা নিরর্থক। ঢাকা গ্যারিসন এখন সম্পূর্ণভাবে আমাদের কামানের আওতায়।’

রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সৈন্যরা দলে দলে অস্ত্রসম্বরণ করতে থাকে। দুপুরের দিকে বগুড়ার পাকিস্তানী ডিভিশন হেড-কোয়ার্টার ও ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের পতন হয়। আত্মসমর্পণ করে পরাজিত বাহিনীর ১৭০০ সৈন্য ও অফিসার। এখানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ যৌথবাহিনীর হস্তগত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীর ৭নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। শৃঙ্খলা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং সংগঠন- ক্ষমতার কারণে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর অচিরেই সকলের শ্রদ্ধা ও বিস্ময় জাগিয়ে তোলেন। তিনি কোনো বিরাম না নিয়ে দিনের বেলা অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন এবং প্রতি রাতেই গেরিলাদের সঙ্গে অপারেশনে যেতেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের যুদ্ধে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মহানন্দা নদী পেরিয়ে তিনি একের পর এক শত্রু বাংকার দখল করে যখন প্রবল বিপদ উপেক্ষা করে এগুচ্ছিলেন তখন হঠাৎ মাথায় গুলি লাগে তার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধীতে ভূষিত করেন।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড