NewsOne24

রোহিঙ্গা এনআইডি কেলেঙ্কারিতে দুই পরিবারিক সিন্ডিকেট 

স্টাফ রিপোর্টার

নিউজওয়ান২৪

প্রকাশিত : ০১:২২ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংশ্লিষ্ট দুইটি সিন্ডিকেট বিপুল অর্থের বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) ও ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করে দিত। এই কায়দায় প্রতিটি এনআইডি কার্ড বিক্রি করতো তারা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। এই চক্র দুটির নিয়ন্ত্রণকারী ছিল ইসি’র দুই কর্মী। ২০১৫ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য উঠে আসলেও নির্বাচন কমিশনের অনেকটা নিরব ও দায়সারা ভূমিকার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে।

রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড প্রাপ্তি ও ভোটার হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় দুদক গঠিত এনফোর্সমেন্ট টিম গতকাল (বৃহষ্পতিবার) দুদক চেয়ারম্যানের কাছে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। 

ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড কেলেঙ্কারিতে একাধিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধির অর্পিত মতা অপব্যবহারের বিষয় উঠে এসেছে। প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি যন্ত্রপাতি আত্মসাৎ করে রোহিঙ্গাদের নামে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান, নাগরিকত্বের সনদ প্রদান, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তকরণ, এনআইডি প্রদান ও পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তার প্রাথমিক সত্যতাও পাওয় গেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানেরও সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ অনুসন্ধানের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা নিশ্চিত করে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপপরিচালক মাহবুব আলম বৃহস্পতিবার বলেন, ‘নির্ধারিত সময়েই আমরা প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে আমাদের মনে হয়েছে এই দুর্নীতির সাথে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। আমরা বিস্তারিত তদন্তের জন্য আবেদন করেছি। অনুমোদন পেলে দুদকের এই তদন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

দুদকের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান হচ্ছেন (দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক) রতন কুমার দাশ। অপর দুই সদস্য হলেন, উপসহকারী পরিচালক শরিফ উদ্দিন ও উপসহকারী পরিচালক জাফর সাদেক শিবলী।
পরিবারকেন্দ্রীক ২ সিন্ডিকেট
রোহিঙ্গাদের অবৈধ কায়দায় ভোটার করতে জড়িত নির্বাচন কমিশনের কমপে ২টি সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম। এর একটির নিয়ন্ত্রক চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের পিয়ন জয়নাল আবেদীন। অপর গ্র“পটির নাটের গুরু ছিল নির্বাচন কমিশন প্রধান কার্যালয়ের এনআইডি প্রজেক্টে কর্মরত টেকনিক্যাল এক্সপার্ট শাহানূর মিয়া। দুজনের মধ্যে জয়নাল আবেদীনকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ইসি’র এনআইডি উইংয়ের তদন্ত দল আটক করে। এসময় চুরি হওয়া নির্বাচন কমিশনের একটি নিবন্ধিত ল্যাপটপ পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা করা হয়েছে। 
এই জয়নালের অন্তত ১০ জন আত্মীয় চাকরি করছেন নির্বাচন কমিশনে। ২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন জয়নাল। একই সময়ে তার ভগ্নিপতি নুর আহমদও যোগ দেন অফিস সহায়ক পদে। নুর আহমদ এখনো আছেন চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে। আবার কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী মোজাফফর হচ্ছে গ্রেপ্তার জয়নালের খালাত ভাই। রাঙ্গামাটি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী মোহাম্মদ আলীও জয়নালের নিকটাত্মীয়। আর কমিশন সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওসমান গণি এই মোহাম্মদ আলীর ভাগ্নে।

জয়নাল সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলো- ঢাকায় এনআইডি প্রজেক্টে পূর্বে কর্মরত টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে এবং সাগর (দুই জনই সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের দায়ের করা মামলার আসামি), জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী, জেলা নির্বাচন অফিসে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করা রিশি। এছাড়া রোহিঙ্গা সরবারহ করে জয়নাল আবেদীনের বেতনভূক্ত সেক্রেটারি জাফর, অস্থায়ী অপারেটর সৈকত বড়–য়া, শাহজামাল, পাভেল বড়–য়া, জয়নালের বোন জামাই বয়ান উদ্দিন ও জনপ্রিয় বড়–য়া। কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসেন কক্সবাজার জেলার নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মোজাফফর ও দালাল নজিবুল্লাহ।
গ্রেপ্তার জয়নাল আবেদীন নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়ার ভাগ্নে। জয়নাল ও জকরিয়া দু’জনের বাড়িই বাঁশখালী উপজেলায়। জয়নালের আত্মীয়-স্বজন যারা নির্বাচন কমিশনে চাকরি করছেন, তাদের অধিকাংশের বাড়িও বাঁশখালীতে। এই সিন্ডিকেটের সবাই ২০০৪ সালে মোহাম্মদ জকরিয়ার সুপারিশে চাকরি পেয়েছেন বলে দুদক তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে।
রোহিঙ্গাদের অবৈধ উপায়ে ভোটার করতে নির্বাচন কমিশনের ২য় সিন্ডিকেটটি হলো: শাহানুর গ্র“প। তিনি নির্বাচন কমিশন প্রধান কার্যালয়ের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে এনআইডি প্রজেক্টে কর্মরত। তার ১০ এর অধিক নিকটাত্মীয় মাঠ প্রকল্পের প্রায় প্রত্যেকটি ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচিতে কর্মরত রয়েছেন বলে খোঁজ পেয়েছে দুদক। তার সিন্ডিকেটে রয়েছেন: চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ নির্বাচন অফিসের অপারেটর তাসলিমা আক্তার, চট্টগ্রাম জেলার ডাবলমুরিং নির্বাচন অফিসে তার আপন ছোট ভাই শাহজামাল, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী নির্বাচন অফিসের অপারেটর তার ভাগিনা জাহিদ হোসেন, কক্সবাজার সদর নির্বাচন অফিসের অপারেটর শাহানুরের খালাতো ভাই নঈম ইসলাম, আরেক খালাতো ভাই শাহ আলম বোয়ালখালী নির্বাচন অফিসের অপারেটর ও শাহানুর মিয়ার বন্ধু কক্সবাজার রামু নির্বাচন অফিসের অপারেটর হিরো। এছাড়া হালনাগাদে আরো রয়েছে শাহানুরের আপন খালাতো দুই বোন অপারেটর ইয়াসমিন আক্তার রূপা ও ফারজানা আক্তার। শাহানুর মিয়ার মামা শহীদুল্লাহ তাকে লোকবল সংগ্রহ করে এসব অপকর্মে সহায়তা করেন।
উল্লেখ্য শাহানুর মিয়ার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায়। তার সিন্ডিকেটের অন্যান্যদের বাড়িও আশেপাশের উপজেলায়। 
মামলার এজাহার নিয়ে প্রশ্ন
দুদক তদন্ত শুরুর পর তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশনের প থেকে জয়নালকে আটক করে তাঁর বিরুদ্ধে নগরীর কোতোয়ালী থানায় যে মামলা রুজু করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দুদক কর্মকর্তারা। কারণ হিসেবে তারা জানান, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি কর্তৃক দুদকের তফশিলভূক্ত অপরাধের জন্য কোনো মামলা রুজু/রেকর্ড করার মতা থানা পুলিশের নেই। কারণ, দুদক বিধিমালা-২০১৯ সংশোধনে বলা হয়েছে, দুদকের তফশিল অপরাধের মামলা দুদক কার্যালয়ে রেকর্ড করতে হবে। সে মোতাবেক ইসির মামলাটিও রেকর্ড করার আইনত মতা একমাত্র উপপরিচালক দুদক, চট্টগ্রামের। কি কারণে ইসি কর্তৃক মামলাটি দুদকের তফশিলের বাইরে করা হয়েছে এবং কোন স্বার্থে কোন কোন রাঘববোয়ালকে বাঁচানোর অপচেষ্টায় দুদককে পাশ কাটিয়ে একটি ত্র“টিযুক্ত মামলা করা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন দুদক কর্মকর্তারা।
২০১৪ সালে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ দিয়ে ২০১৫ সালে ভোটার হয় নূরু ডাকাত
নির্বাচন অফিস থেকে জানানো হয়, আলোচিত ৪৩৯১ নং আইডি ল্যাপটপটি ২০১৪ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় হারানো যায়। চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান বর্ণিত ল্যাপটপটি গত ২০১৪ সালে হারিয়ে যায় মর্মে মৌখিক তথ্য প্রদান করলেও এতদবিষয়ে কোনো জিডি কিংবা অফিসিয়াল নোটিং সরবরাহ করতে পারেননি। সম্প্রতি বন্দুক যুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নুর আলমের এনআইডিটি ল্যাপটপ নং ১৫৫৭-৪৩৯১ (১৫৫৭ হল পাঁচলাইশ উপজেলার আইডি এবং ৪৩৯১ হল ল্যাপটপ আইডি) ব্যবহার করে করা হয়েছিল বলে দুদক জানতে পেরেছে। 
সন্দেহ ৩ ট্রাভেল এজেন্সিকে
বাবুস সালাম ট্রাভেল এজেন্সি, কর্ণফুলী ট্রাভেল এজেন্সি ও চট্টগ্রামের বিবিরহাটের এন কে/ নূর ট্রাভেলস রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রদানে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

নিউজওয়ান২৪.কম/আরকে