ঢাকা, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

স্মৃতিতে ‘৭১

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

প্রকাশিত: ১২:৩১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

‌‘এক-একটা মুখ যেন বালির ভেতরে পোঁতা আধেক নৌকার মতো
অবয়ব নাক মুখ স্পষ্ট নয়, ঠিকানা হারিয়ে গেছে, বাড়িঘর বিষয়-আশয়—
ছিল নাকি কেউ মায়ের আঁচলে ধন, পিতার আশার স্বপ্নঘেরা ছেলে,
কোনো তরুণীর গোপন চাহনি পড়েছিল কারও মুগ্ধ নওল দু’চোখে কিনা,
আজ আর জানবার কোনোই উপায় নেই।
নামটুকু কেবলি উদ্ধার করি
নথিপত্র ঘেঁটে’- খোন্দকার আশরাফ হোসেন

আমার ধারণা স্মৃতি ও আমাদের পাঠ করা ইতিহাসের মধ্যে প্রবল পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে। পুস্তকে লিপিবদ্ধ ইতিহাস মূলত অতীতের বিমূর্ত পর্যবেক্ষণ। অতীতের বিস্তার বা শিকড় যত বেশি নিম্নগামী হবে, ততই বাড়তে থাকবে এর বিমূর্ততা। ইতিহাস প্রণয়নের সময়ে ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক সরলীকরণ করার প্রবণতা এর প্রধাণতম কারণ বলে আমি মনে করি।

ফলে ইতিহাস মানুষ তথা মানবসভ্যতাকে প্রতিবিম্বিত করার নিমিত্ত হলেও ইতিহাসের ধারা বর্ণনার ভেতরেই ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক মানুষেরা বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যায়। অথচ ইতিহাস সংগঠনের মুহূর্তগুলোতে উপস্থিত থাকা কোন ব্যক্তির কর্মকাণ্ডই তুচ্ছ নয়। যেমন, আত্নপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বা যুদ্ধে পিতা-মাতা নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ করেও সন্তানদের যুদ্ধে পাঠান; নারী প্রিয়জনকে যুদ্ধে পাঠিয়ে হানাদারদের নির্মমতা ও বর্বরতার শিকার হয়; নবীন শিশু মুখোমুখি হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের; কিশোর জীবন বিপন্ন করেও পক্ষের যোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করে; জননী মাতৃস্নেহে মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়ায়; বর্ষীয়ান মানুষেরা অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে প্রতিরোধের পথ বাৎলে দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ইতিহাসে এদের কারুরই নাম লেখা থাকে না।

ইতিহাস রচনা করার সময়ে ঐতিহাসিকগণ সংঘটিত ঘটনা সমুহ হতে কিছু কিছু বিশেষ ঘটনাকে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করণের নিমিত্তে নির্বাচন করে থাকেন। উপরোল্লিখিত ঘটনা সমুহ ব্যতীত অন্য সকল ঘটনাই অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতে হতে এক সময়ে বাদ পড়ে যায়। এর কারণ হল, ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস লিখতে গিয়ে প্রথমেই কিছু নির্দিষ্ট থিমকে উপলক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। এই থিমগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করাই হয়ে উঠে তাদের প্রধাণ কাজ। এটা করতে গিয়ে তারা দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন আপাত গুরুত্বপূর্ণ সীমিত সংখ্যক কিছু বিষয়ের ওপরে। সংকলিত ইতিহাসে এই আপাত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা বিষয়গুলোরই শুধুমাত্র প্রতিফলন ঘটে থাকে। যেমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম, তাদের অবদান, ঘটনার সাল, স্থান কিংবা শুধুই ঘটনার বার্ডস আই ভিউ। ফলে অবশিষ্টরা হয়ে পড়ে পরিত্যাক্ত।

মানব ইতিহাসে এই নির্বাচিত তথ্যাদিই ইতিহাস রূপে মনের ভেতরে স্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। যেমন বাংলাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ, মহাত্না গান্ধী, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ১৯৪৭ সনে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি, পাকিস্তান সৃষ্টির পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, সালাম, রফিক, জব্বার, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি শব্দগুলো স্থায়ী রূপ পেয়েছে। খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন ইতিহাসের এই ধরনের শব্দমালায় প্রাকৃতজনদের অংশগ্রহণ বা আনন্দবেদনার খুব বেশী কোন প্রতিফলন নেই। এরা শুধুমাত্র কিছুকাল নিজেদের নিবিড় পরিচিতজনদের স্মৃতিতে বিরাজ করেন। অতঃপর হারিয়ে যান বিস্মৃতির অন্তরালে। চিরকালের জন্যে! অথচ এরাই পরিবর্তনের ধারক বাহক হিসেবে কাজ করেছে।

এ কারণেই আমার কাছে ব্যক্তিগত পর্যায়ের স্মৃতির আবেদন লিপিবদ্ধ ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি। মানুষের স্মৃতি একটা অদ্ভুত ব্যাপার। নিমেষের মধ্যে আপনাকে পৌঁছে দিতে সক্ষম আপনার শৈশবের দিনগুলোতে। কোন ধরণের চেষ্টা ছাড়াই। কারণ স্মৃতি একটা জটিল প্রক্রিয়া যেখানে আপনি, আপনার অতীত, অতীতের প্রিয় পরিচিত জন– সবাই অদ্ভুত এক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আপনার সামনে উপস্থিত হতে পারে। ফলে বর্তমানে অবস্থান করেও আপনি অতীতে ফিরে গিয়ে নিবিড়ভাবে সবার চলার পথ ধরে হাঁটতে পারবেন। শুনতে পাবেন অন্যদের চলার পদশব্দ। দেয়ালের এপার থেকেই আপনি নিজের পদশব্দ শুনলেও অবাক হবার কিছুই নেই। আসলে স্মৃতিতো শুধুমাত্র অবলোকন নয়। এটা আপনার দৃষ্টি, শ্রুতি, অতীতের বিরাজিত অবস্থা, সামগ্রিক ভাবনা-চিন্তা, - সব কিছু মিলেই সংগঠিত হয়। এই একত্রীভূত সকল তথ্যমালাই স্মৃতি, যা আপনার ভেতরে সামগ্রিক সত্যের উপলব্ধি সৃষ্টি করে। ইতিহাসে লেখা না থাকলেও এদের গুরুত্ব কখনই কম নয়।

১৯৭১ সনে আমি ছিলাম নিতান্তই শিশু। তারপরেও আমার কিছু স্মৃতি আছে যেগুলো সারাক্ষণ জ্বলজ্বল করে। আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে সে বছর বর্ষার সময়ে আমাদের পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলো ফরিদপুর থেকে আগত এক অধ্যাপক পরিবার। তারা হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে পালিয়ে এসেছিল। এই পরিবারের সাথে এসেছিল একজন সদ্য কিশোর। অধ্যাপকের ছোট ভাই। নাম মানিক। আমার স্পষ্ট মনে আছে মানিক আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে ঝাড়কাটা প্রাইমারি স্কুলের প্রাঙ্গণে ছোট্ট একটা মুদীর দোকান দিয়েছিল।

আমাদের মাদারগঞ্জ থানায় দুটো মুক্তিযোদ্ধাদের দল অবস্থান নিয়েছিল। সম্ভবত দুইটি কোম্পানি। একটা থানার দক্ষিণ দিকে। আমার নানাবাড়ির কাছে। অন্যটা উত্তর দিকে। আমাদের স্কুল ঘরে তারা কয়েকদিন অবস্থান করেছিল। পরে তারা ইসলামপুর বা অন্যত্র চলে গিয়েছিল। এই দলে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সম্ভবত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার হাতে ছিল একটা ছিদ্রযুক্ত স্টেনগান। আমি ভাবতাম এই ছিদ্রগুলো দিয়ে গুলি বের হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি ঝাড়কাটা নদীর তীরে দীর্ঘ সারিতে অনেকগুলো পরিখা বা ট্রেঞ্চ খনন করেছিল। আমরা শিশুরাও তাদের অনুকরণে আমাদের বাড়ির আশেপাশের পগারের পাড়, বাঁশের ঝাড় খানাখন্দকে ভরিয়ে দিয়েছিলাম। এটাই ছিল আমাদের খেলা। যুদ্ধের সময়ে শিশুদের খেলার রকমফেরও বদলে যায়!

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আমাদের বাড়ির কাছারিঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। উজ্জ্বল বড় বড় চোখের এক যুবক। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে কাঁধে করে বহন করে নিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আমি তাকে ভাই বলে ডাকতাম। অথচ তার নামটাই আমার স্মৃতিতে নেই। শত চেষ্টা করেও নামটাকে বিস্মরণের ওপার থেকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি। মাঝে মধ্যেই আমার সন্দেহ হয় আমি সত্যিই তার নাম আদৌ জানতাম কিনা। কোন যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন সেটাও আমার জানা ছিল না। হয়তবা কামাল পুরের প্রথমদিকের কোন যুদ্ধে। কিন্তু তার চেহারাটা এখনও আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে। উজ্জ্বল বড় বড় চোখ। হালকা শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে হাসির রেখা। ডান পায়ের হাঁটুর ওপরের ঊরুর উপরে একটা বিরাট গোলাকৃতি ক্ষত। ছিদ্রের মত। এখান দিয়ে গুলি ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে আমি শুনেছিলাম। প্রতিদিন নিজ থেকেই এই ক্ষতস্থান পরিস্কার করতেন। আমার সাথে তার সম্পর্কটা ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের। যুদ্ধে গমন, অংশগ্রহণ, আহত হওয়া সবকিছু সম্পর্কেই সম্ভবত তিনি আমাকে বলেছিলেন। তবে তার বলা গল্পগুলো আমার স্মৃতিতে নেই। বিস্মৃতি ডালপালা মেলে সব ঢেকে দিয়েছে। তবে মনে আছে বিজয়ের মাসে তিনি আমাদের বাড়ি হতে চলে গিয়েছিলেন। কোনদিন ফিরে আসেন নি। স্মৃতি আসলেই অদ্ভুত! কোনটা আপনার মনে থাকবে, কোনটা মনে থাকবে না, সেই নির্বাচনও তার। আপনার-আমার কিছুই করার নেই। তিনি কি যুদ্ধের পর জীবিত অবস্থায় নিজের পরিবারের কাছে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন? কে জানে?

আমরা শিশুরা সেই সময়ে কিভাবে বড় হয়ে উঠছিলাম সে সম্পর্কেও নিজের একান্ত স্মৃতি ছাড়া আর কোন অভিমুখ নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে, বড়দের চিন্তাভাবনার ভেতরে আমরা ছিলাম না। বড়রা সেই সময়ে ব্যস্ত ছিলেন আরও জরুরী বিষয় নিয়ে। যেমন বেঁচে থাকা, অন্যদের বাঁচিয়ে রাখা, দেশকে স্বাধীন করা ইত্যাদি। তবে একবার ঝাড়কাটা নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানী বাহিনীর আমাদের এলাকায় প্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দিলে আমাদের এক চাচার নির্দেশে আমরা বাড়ির উঠোনের উপরে একটা বিরাট গোলাকার পরিখা খনন করেছিলাম। বিশাল এক ইঁদারার মত দেখতে। আমার সেই চাচা বলেছিলেন,” হানাদার বাহিনী যদি সত্যিই আক্রমণ করে তবে আমরা পালিয়ে যাব না, প্রতিরোধ গড়ে তুলব এবং হেরে গেলে সবাই এসে এই কুয়ার ভেতরে প্রবেশ করে আত্নাহুতি দেব। এই রকমের একটা বীরোচিত মৃত্যুর ধারণা আমাদের ভেতরে আনন্দের সৃষ্টি করেছিল। ভয় ডর বলে কিছুই ছিল না আমাদের।

আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে উত্তরে তাকালে পাহাড়। দিগন্তের ওপারে নীলের চেয়েও ঘন নীল পাহাড়। গারো পাহাড়ের চূড়া/রিজলাইন। অতঃপর আসামের মেঘালয় রাজ্য। ঝাড়কাটা নদী, ঝিনাই নদী, ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে তেপান্তরের ওপারে এর অবস্থান। এর আশেপাশেই কোথাও কামালপুরের যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধের কথা ঐ সময়ে আমি শুনিনি। তবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমি এই এলাকার ওপর দিয়ে আমি ভারতীয় বোমারু বিমান উড়তে দেখেছি। জোড়ায় জোড়ায়। বাড়ীর উঠোন থেকে। মেঘের গর্জন নিয়ে। অনিমেষ নয়নে আমি তাকিয়ে দেখতাম বিমানগুলো দিগন্তের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। গারো পাহাড় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে! দেখতে ঠিক সবুজ প্রান্তরের ওপর দিয়ে সকালের আলোয় উড়ে যাওয়া যুগল ঘাস ফড়িঙের মত। কামাল পুরের যুদ্ধের বৃত্তান্ত আমি শুনেছি বড় হবার পর। সেনাবাহিনীতে কনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে চাকুরী করার সময়ে। সামরিক ইতিহাসের পাঠ হিসেবে।

এই যুদ্ধ ছিল বীর বাঙালীদের প্রথম কনভেনশনাল যুদ্ধ। মাত্র নয় মাসের সময়কালের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচলিত যুদ্ধ দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপরে আক্রমণ করে সত্যিকার অর্থেই প্রমাণ করেছিলেন যে বাংগালিরা যোদ্ধার জাত। প্রাণ থাকতে বিনাযুদ্ধে মাতৃভূমির সুচাগ্র পরিমান জমিও ছাড়তে প্রস্তুত নয়। এই যুদ্ধেই মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রথম সামরিক সাজে সজ্জিত হয়ে দুই কোম্পানি জনবল নিয়ে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপরে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। কিন্তু রিকনাইসেন্স পর্যায়ে (অপারেশনের পূর্বে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে গোপনভাবে তথ্য সংগ্রহ করার সময়ে) সামান্য বিচ্যুতি ঘটে। ফলে শত্রুরা তাদের উদ্দেশ্য জেনে যাবার কারণে মুল আক্রমণ পরিচালনার সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিপতিত হয় পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের সমন্বিত ফায়ারের মুখে। হতাহত হয় অনেক মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি দুই কোম্পানির অধিনায়কদ্বয়ও।কিন্তু এই আপাত পরাজয় তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। জুলাই ও অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা চারবার পাকিস্তানী এই প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপরে আক্রমণ করে পর্যায়ক্রমে তাদেরকে দুর্বল করে দেয়।

পরের ইতিহাস বাঙ্গালী জাতির সর্বাত্নক জেগে উঠার গল্প। ২১ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে যুদ্ধকালে গড়ে উঠা হবু বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সমন্বিতভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিচালিত হয় অপারেশন লাইটনিং ক্যাম্পেইন। আমি তখন এগুলোর কিছুই বুঝতাম না। তবে আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যুগল ভারতীয় বোমারু বিমান। সেদিন তারা উড়ছিল জামালপুর-কামালপুরের আকাশে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় আর্টিলারি ও সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করে। নভেম্বরের ২৩ তারিখ দিবাগত রাতে কামালপুরে অবরোধ করা হয় এবং কামালপুরকে তাদের মূল বাহিনী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং রসদ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ৪ঠা ডিসেম্বর বিকাল ৩টার সময় কামালপুর মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিয়মিত বাহিনীর ২২০ লোক এবং বিপুল অস্ত্ৰ শস্ত্রসহ পাকসেনারা বন্দী হয়। বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর এই ছিল প্রথম আত্মসমর্পণ।

অপারেশন লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign) নামের মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসে ঢাকার দিকে। চতুর্দিক থেকে। অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ফ্রান্স দখল করার জন্যে জার্মানদের কর্তৃক পরিচালিত Blitzkrieg অপারেশনের গতি নিয়ে। জয়যাত্রা ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিগদিগন্তে। ৬ ডিসেম্বর তারিখে মুক্ত হয় দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও শেরপুর। ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় জামালপুর!

আমরা শিশু হলেও বুঝতে পারি যে, আমাদের চারপাশ ক্রমশ প্রকম্পিত হয়ে উঠছে হাজার হাজার মানুষের 'জয় বাংলা' স্লোগানে। ডিসেম্বরের ১১ তারিখ প্রত্যূষে কাদের বাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর বিমান থেকে সাত শতাধিক প্যারাট্রুপার অবতরণ করে ঢাকার অদূরে শ্রীপুরের নিকট। উদ্বেলিত জনতা তাদের স্বাগত জানায়। নিজ থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারা বয়ে নিয়ে যায় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের রসদ ও মালামাল। আমি নিজ চোখে না দেখলেও অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পাই সব।

অবশেষে সেই মহার্ঘ মূহুর্ত। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। বিকেল ৩ ঘটিকা। রমনার রেসকোর্স ময়দান। লোকে লোকারণ্য। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। ৯ মাসের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর অযুত মা বোনের শ্লীলতাহানির বিনিময়ে আকাশে উজ্জ্বল হয়ে উঠে স্বাধীনতার সূর্য। রক্তের মত টকটকে লাল!

“জীবন তো কেবল বেঁচে থাকা নয়। জীবন হচ্ছে সেটাই যা আপনি মনে রাখছেন। জীবনের ঘটে যাওয়া সেইসব স্মৃতি যা আপনি স্মরণ করেন, বর্ণনা করেন, আর যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় করেন সেটাই আসলে কারো জীবন”- গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

[১৯৬৫ সালে জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ। পড়াশোনা করেছেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রয়্যাল বোর্ডস ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। সামরিক বাহিনীতে দীর্ঘদিন চাকরি শেষে লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘অন্য জীবন’, অতীত স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, দর্শন তত্ত্ব ও ফিকশন নিয়ে অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অনুবাদ সাহিত্যেও রয়েছে মুন্সিয়ানা]

সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড

আরও পড়ুন
অসম্পাদিত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত