ঢাকা, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

১৫ আগস্ট-ই কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা?

অসম্পাদিত ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২২, ১৫ আগস্ট ২০১৭  

কিছু বিপথগামী সেনা অফিসার সদ্য স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে খুন করে তা প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছিলেন। কেন হত্যা, কীভাবে হত্যা তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে দাম্ভিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এমনকি কেন আগস্ট মাসেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে হত্যা করা হয়, তাও জানান কলঙ্কিত দুই সেনা অফিসার।

১৯৭৬ সালে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মেজর ফারুক ও রশিদ এসব কথা বলেন। সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস এই সাক্ষাতকার নেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত হয় খুনিদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মধ‌্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত‌্যা করে একদল সেনা সদস‌্য।

এই খুনের পর বদলে যায় সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া দেশের সার্বিক অবস্থা। সব দিকে তখন ভয়ের রাজত্ব। সেনা শাসনের হাতে চলে যায় দেশ।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থাইল্যান্ড হয়ে লন্ডনে পালিয়ে যাওয়ার বছর খানিকের মাথায় সেখানে দেওয়া ওই সাক্ষাতকারে ফারুক বলেন, ‘অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছিল যে মনে হচ্ছিল, আমরা একটা ক্রিমিন্যাল সংস্থার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।’ এ সময় রশিদ বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) সবাইকে দুর্নীতিপরায়ণ হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।’

মুজিবকে হত্যা না করে আত্মসমর্পণ করানো যেত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রশিদ বলেন, ‘তাকে (বঙ্গবন্ধু) যদি বাঁচিয়ে রাখা হতো, তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

এ জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রশিদ বলেন, ‘হ্যাঁ’। আর ফারুক বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিই যে তাকে (বঙ্গবন্ধু) এই পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু এ সময় ১৯৭৪ সালের মার্চে আমি ছিলাম পুরোপুরিভাবে একজন পেশাদার সৈনিক। আমার কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল না। কিন্তু একটা বিষয় বুঝতাম না যে, তাকে সরাবার পর কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং প্রতিক্রিয়া কী হবে। তাই আমি বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করা শুরু করলাম।’

মুজিবকে সরিয়ে কাকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে রশিদ বলেন, ‘আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল জেনারেল জিয়া, এর জন্য অনেক চেষ্টার পর ৭৫’র ২০ মার্চ তার সাথে দেখা হয়। জেনারেল জিয়া বলেন, আমি একজন সিনিয়র অফিসার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমি জড়িত হতে পারি না। কিন্তু তোমরা জুনিয়র অফিসাররা আগ্রহী হলে, এগিয়ে যেতে পারো।’

শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাতের পরিকল্পনা জিয়াকে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল কিনা সেই প্রশ্নের জবাবে রশিদ বলেন, ‘…কথাটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পাড়তে হয়েছিল। আলোচনার আসল জায়গায় এসে বলেছিলাম যে, ব্যাপক দুর্নীতি চলছে, কিছুই ঠিকভাবে চলছে না, সেজন্য একটা পরিবর্তন দরকার। এসব শুনে জেনারেল জিয়া বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো আমরা বাইরের লনে যেয়ে বসে আলাপ করি।’
‘হ্যাঁ, এরপর আমরা লনে গেলাম। আমি তাকে বললাম, আমরা হলাম পেশাদার সৈনিক। আমরা দেশকে সেবা করি, কোনো ব্যক্তিবিশেষকে নয়। সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল সার্ভিস, সরকার সব কিছুই রসাতলে যাচ্ছে।

আমাদের এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমরা জুনিয়র অফিসাররা এর মধ্যেই এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছি। আমরা আপনার সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনা করছি। তিনি বললেন, আমি দুঃখিত, এ ধরনের কিছুর মধ্যে জড়াতে চাই না। যদি তোমরা কিছু করতে চাও, সেক্ষেত্রে জুনিয়র অফিসারদের নিজেদের করা উচিত’, যোগ করেন রশিদ।

এরপর মোশতাকের সঙ্গে ১২, ১৩ এবং ১৪ আগস্ট সাক্ষাৎ করেন রশিদ। বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে কথা বলেন। সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা না বলে ইঙ্গিত দেওয়ার কথা জানান তিনি। রশিদ বলেন, ‘তবে তাকে (মোশতাক) এমনভাবে বলা হয়েছে যে, ক্ষমতা থেকে ওদের বল প্রয়োগে হঠানো হবে এবং কাজ করতে যেয়ে মুজিবকে হত্যা করা যেতে পারে।’

সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মোশতাককে কোনো ধারণা আগে থেকে দেওয়া হয়নি। কারণ তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি রশিদরা। পরিকল্পনার কথা বঙ্গবন্ধুকে বলেও দিতে পারেন মোশতাক এমন শঙ্কাও তাদের মধ্যে ছিল।

এরপর অভ্যুত্থানের তারিখ নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন ফারুক। কাজটা কখন সুবিধাজনক হবে সেটা নিয়েও চিন্তা করেন তিনি। এক প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে ফারুক বলেন, ‘অবশ্য এ সময় আমার লোকদের ইউনিটে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি। এই ট্রেনিং হচ্ছে প্রতিমাসে দুবার করে রাত্রীকালীন ট্রেনিং।’

এই ট্রেনিংয়ের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সম্পর্ক থাকতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, ‘অপারেশনের কথা চিন্তা করেই এই বিশেষ ট্রেনিং কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছিল। কেননা রাতের অসময়ে ট্রেনিং ইউনিটের চলাচল নজরে পড়তে বাধ্য। এজন্যই কর্মসূচি মার্চ থেকে প্রতিমাসে দুবার করে ‘রাত্রীকালীন ট্রেনিং’ শুরু করলাম।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৫ আগস্টকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে ফারুক বলেন, ‘প্রথমত, ১৪ বা ১৫ আগস্টের রাত হচ্ছে রাত্রীকালীন ট্রেনিংয়ের পূর্ব নির্ধারিত তারিখ। দ্বিতীয়ত, বর্ষাকালে বাংলাদেশে আক্রমণ করা খুবই দুরূহ। এ সত্ত্বেও যদি ভারত তা করে, তাহলে কমপক্ষে ভারতকে ৬ থেকে ৮ ডিভিশন সৈন্য এতে জড়াতে হবে।’

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করলে ভারত প্রয়োজনীয় ত্বরিৎ প্রক্রিয়া দেখাতে পারবে না বলে মনে করছিলেন ফারুক। তবে এই হত্যার সাথে ভারতের চিন্তা কেন মাথায় এলো, কিংবা ভারতের দিক থেকে কোনোরকম আক্রমণ আঁচ করছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, ‘হ্যাঁ। কেননা শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে চুক্তি দস্তখত করেছে, তার একটিতে এ মর্মে শর্ত রয়েছে যে, দেশে কোনো গণ্ডগোল হলে উনি ভারতীয় সৈন্য ডেকে পাঠাতে সক্ষম।’

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ফারুক বলেন, ‘আমি শেখ মুজিবের বাসায় দিকে অগ্রসর হই। শেখ মুজিবের বাসায় আমাদের লোক আমাকে থামিয়ে বলল, ‘সব কিছু ঠিক আছে।’ সব কিছু ঠিক আছে মানে হলো মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’

সেদিন কেন শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শেখকে বলা হয়েছিল আত্মসমর্পণের জন্য এবং নিচে নেমে আসার জন্য। কিন্তু তিনি ঘরের মধ্যে চলে গেলেন এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারে ফোন করলেন। তার সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য তিনি শফিউল্লাহ এবং মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে বললেন। এমনকি রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারেও ফোন করলেন। সবাই তাকে জানালো যে, তারা শীঘ্রই হাজির হবেন। মনে হয়, এতেই তিনি সাহস পেলেন এবং ছেলেমেয়েদের বললেন প্রতিহত করতে।’

ফারুক আরও বলেন, ‘এরপর ওরাই গোলাগুলি শুরু করে। আমাদের সৈন্যদের একজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আহত হয় আরও চারজন। ঘটনা যখন ঘটেই গেল, তখন আর সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। আমরা তাকে (মুজিব) আসতে বললাম। তারা গুলি করল এবং আমরা ঘরের মধ্যে গ্রেনেড নিক্ষেপ করলাম। যেহেতু কামরা বন্ধ ছিল এবং সবাই ওখানেই ছিল। পরিবারের মহিলা ও শিশুও ছিল। তাই এ্যাকশনের দরুণ এরাও নিহত হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে পাঁচজন লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয়।

আর পলাতক রয়েছেন খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, রিসালদার মোসলেমউদ্দি, এম রাশেদ চৌধুরী, এ এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও আব্দুল মাজেদ। তারা সবাই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

নিউজওয়ান২৪.কম

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত