ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

নিষিদ্ধ দেশযাত্রা!

মনির স্বপন

প্রকাশিত: ১৪:৩৮, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০২:১৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

ইসরায়েলি বিমানবন্দরে

ইসরায়েলি বিমানবন্দরে

প্রায় ২২০০ আস্ট্রেলিয়ান ডলার দিয়ে এল- আল এয়ারলাইন্সের টিকেট কিনে ফেললাম। সিডনি থেকে হংকং হয়ে তেল-আভিবের বেনগুরিয়ান বিমানবন্দর। একটানা ২৪ঘণ্টার মতো ফ্লাইট। ট্রাভেল ইনস্যুরেন্সও করে ফেললাম। কারণ, গন্তব্যটা হচ্ছে ইসরায়েল। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়!

আমার সফরসঙ্গী এক চাচাতো ভাই। ইসরায়েল নিয়ে তার আগ্রহও অনেক।

এল-আল হলো ইসরায়েলের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান পরিবহন সংস্থা। আর ঠিক এই কারণেই বিশ্বের শীর্ষ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য হামলার তালিকার প্রথমসারিতে এর অবস্থান। জঙ্গি হামলা ঠেকাতে অভাবনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে এই বিমান সংস্থা। বিমানে ওঠার আগে প্রতিটি যাত্রীকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এছাড়া এল-আল হল পৃথিবীর একমাত্র বিমান সংস্থা, যাদের প্রতিটি যাত্রীবাহী বিমান ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত থাকে। বিমানবালারা বেশিরভাগই হয়ে থাকে সাদা পোশাকধারী সামরিক বাহিনীর সদস্য। এছাড়া আরও থাকে সাদাপোশাকধারী সামরিক বাহিনীর সশস্র সদস্য যাদের বলা হয় এয়ার মার্শাল। এটা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইটগুলোতেও থাকে। পাইলট হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর সাবেক পাইলটদের। বিমানের ককপিটে থাকে দুই পর্যায়ের দরজা। এত নিরাপত্তার পরেও এই এল-আল এয়ারলাইন্সের বিমানগুলো সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে।

যাত্রার দিন ভোর ৫ টায় বাসা থেকে রওনা হলাম। চাচাতো ভাইয়ের চোখ জ্বল জ্বল করছে উত্তেজনায়। আমিও একরকম অজানা উত্তেজনা আর আশঙ্কায় সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
বাসা থেকে বের হবার সময় চাচী আর চাচাতো ভাইয়ের বউ করুন চোখে বিদায় জানাল।

কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা সিডনি-হংকং ফ্লাইট পার করে দিলাম। কেয়ামত শুরু হল হংকং নামার পর থেকে। প্লেন থেকে নামার পর প্রথমেই দেখি আমাদের নাম লিখা কাগজ উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শনা তরুণী। সে আমাদের এখানে সেখানে ঘুরাতে ঘুরাতে নিয়ে হাজির করলো তেল-আভিবগামী বিমানের বোর্ডিং এলাকায়।

বলে রাখি সিডনি থেকে আমাদের এই পর্যন্ত দুই বার নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়। আমাদের ব্যাগগুলো স্ক্যানারে পরীক্ষা করা হয়। বোর্ডিং দরজায় পৌঁছার সাথে সাথে আমাকে আর আমার চাচাতো ভাইকে আলাদা করে ফেলে বিশেষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। চলতে থাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ। আমার নাম কি, বাবা-মার নাম কি, কেন ইসরায়েল যাবো, কই থাকব, কী করবো, আস্ট্রেলিয়াতে কি করি, কে খরচ দিচ্ছে ইত্যাদি।

অন্তত ১৫-২০ মিনিট একই প্রশ্ন বার বার করে আমাদের দুইজনকে নিয়ে যাওয়া হলো আলাদা একটি কক্ষে। সেখানে আমাদের ব্যাগের প্রতিটি জামা-কাপড়ের পকেট, মোবাইল ফোনের ফেসবুক, ইমেইল, ক্যামেরা, SMS ইত্যাদি পরীক্ষা করার পর তারা পাসপোর্ট, টাকা-পয়সা, আর মোবাইল ফোন ছাড়া সব কিছু বিমানের ভেতরে চেক-ইন করিয়ে দিল, আমাদের আর কিছুই রাখতে দিল না।

তারপর শুরু হল আমাদের দুইজনকে আলাদা করে কাপড় খুলে পরীক্ষা। যদিও তারা আমাদের অসম্মানিত করেনি, কিন্তু নিরাপত্তার নামে এত বাড়াবাড়ি আমি আর কোথাও দেখিনি, তাই খারাপ লাগছিল।

পরে চাচাতো ভাই বুঝাল যে নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসরাইলিরা খুবই স্পর্শকাতর।

নিরাপত্তার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা বিমানে উঠলাম, ক্লান্ত হয়ে। হাতের ঘড়িটিও ওরা রাখতে দেয়নি। ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সময়ে সময়ে বিমানবালারা খাবার দিয়ে গেছে কয়েক বার।

ইসরায়েলি বিমানের খাবার খুব একটা খারাপ লাগেনি। তবে বিমানবালাদের দেখে অন্যরকম লেগেছে। তারা কথা খুব কম বলে। মুখে তেমন একটা হাসি নেই। কেমন যেন যান্ত্রিক। অন্যান্য এয়ারলাইন্সের বিমান বালারা আরও অনেক হাসিখুশি হয় থাকে।

বিমান ভর্তি ইসরায়েলি দেখে ধারনা করি হংকং-এ তাদের ব্যাবসায়িক সম্পর্ক নিশ্চয়ই গভীর।
ঘুমিয়ে পার করে দিলাম অধিকাংশ সময়। প্লেন যখন তেল আভিবের আকাশে, তখন হঠাৎ করে বজ্রপাত হল প্লেনের ডানায়। জানালা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে শীতল হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্ত। একবার মনে হয়েছিল এটা কি আসলেই বজ্রপাত নাকি গোলার আঘাত। বেঁচে নামবো তো?

আর কোনো নাটকীয়তা ছাড়াই বিমান তেল-আভিভ নামলো। আকাশ ছিল অনেক মেঘলা। ঝুর ঝুর করে বৃষ্টি হচ্ছিল বেন-গুরিওন বিমান বন্দরে। এত লম্বা বিমান ভ্রমণ জীবনে এই প্রথম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। এরা কাস্টমস বা ইমিগ্রেশন এর জন্য কোন ফরম পূরন করতে বলে না। প্লেনের দরজা খুলে যেতেই সবাই একরকম দৌড়ে বেরিয়ে গেল। হয়তো লম্বা ভ্রমণের ক্লান্তি সবাইকে অস্থির করে দিয়েছে।

ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইন। আবার জিজ্ঞাসাবাদ। সেই একই পুরনো প্রশ্ন। একপর্যায়ে আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ভেতরে কাকে যেন দিয়ে আমাকে বসতে বলল পাশের এক কামরায়। সেখানে দেখি বিভিন্ন দেশের আরও অনেকে। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সব ধরনের মানুষ। বুঝলাম বাঙালি পাসপোর্ট বলে আমাকেই শুধু আটকান হয়নি।

মনে মনে আরও এক দফা জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক এই সময়ে একজন আমার নাম ধরে ডাক দিল। বুঝলাম এবার আমার পালা। ঠিক তখনি আমাকে অবাক করে দিয়ে জানাল, আমি যেতে পারি। হাতে ধরিয়ে দিল পাসপোর্ট।

তবে বেন-গুরিওন বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আরও এক দফা নিরাপত্তা তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছিলাম। এবার এক সাথে তিন জন চৌকস নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাদের বাইরে এনে নিশ্চিত করলো আমরা আসলেই ট্যাক্সিতে উঠছি। শুরু হল জেরুজালেম যাত্রা।

মনির স্বপন: অভিনেতা, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

নিউজওয়ান২৪.কম/এমএস

লাইফস্টাইল বিভাগের সর্বাধিক পঠিত