ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

ধর্ষণের মতো ‘ঘিনঘিনে’ ঘটনার ‘রগরগে’ নিউজ কেন?

বটতলা ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ১৩:৩২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

২০১৫ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো এক রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়, বিগত তিন বছরে ৩৫ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রতিদিন দেশটিতে ৯৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনাই ভারতের প্রিন্ট বা অনলাইন মিডিয়ায় স্থান করে নেওয়ার সুযোগ পায় না। আর যেসব ঘটনা প্রকাশ পায়, তাও যথাযথভাবে মানুষের সামনে উঠে আসে না।

ধর্ষণের মতো যৌন এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক যেকোনো সহিংসতাই মারাত্মক অপরাধ যা ক্ষমতা প্রদর্শন ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত। এই ঘটনাগুলোকে তুলে আনা এবং ভুক্তভোগীর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। `সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন` টাইপ ব্যাখ্যা দিয়ে ভুক্তভোগীর ঘাড়ে দায় চাপানোর স্বভাব সাংবাদিকদের বদলানো জরুরি।

সম্প্রতি মালায়লাম অভিনেত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কাইরালি টিভি এবং হুয়াজ খাস গ্রামের কাছে আরেকটি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন নিয়ে ঝড় উঠেছে চারদিকে। ধর্ষণ ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বিষয়ক রিপোর্ট কেমন হওয়া উচিত নয়- তার উদাহরণ হতে পারে এই দুটো ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো।

হুয়াজ খাস গ্রামে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে টাইমস অব ইন্ডিয়া। সেখানে নয়াদিল্লি থেকে ধর্ষক ওই নারীকে কৌশলে তুলে নিয়ে গ্রামের কাছের `ডিয়ার পার্ক`-এ কীভাবে ধর্ষণ করেছে- সবই তুলে আনা হয়েছে। এরপর মেয়েটির অবস্থা কী হয়েছিল তাও ওঠে এসেছে রগরগে বর্ণনায়। ঘটনা কোথায় কিভাবে ঘটে সবই এসেছে প্রতিবেদনে। ছয় জন অভিযুক্তের কথাও বলা হয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আক্রান্ত মেয়েটির আরো কিছু তথ্য দিয়েছে তারা। সেখানে তার পরিচয়, জাতিগত তথ্য ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি মেয়েটি যেখানে বাস করে তার এক প্রতিবেশীর পরিচয়, মেয়েটি কোথায় কী কাজ করে তাও প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে মূল ঘটনার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছুই দেওয়া হয়েছে যা প্রকাশযোগ্য নয়।  সাংবাদিকতার ইথিকসে পড়ে না, আইনেও সর্মর্থন করে না।
 
এমনকি প্রতিবেদন অতিরঞ্জিত করে এমনভাবে প্রকাশ করা হয়, যেখানে এমন ঘটনা ঘটার পেছনে ভুক্তভোগীর দোষ-ত্রুটি থাকার প্রসঙ্গও ইঙ্গিত করে পাঠক মনে। বয়াবহ অপরাধটা এখানেই। আর একই সঙ্গে এটা অনেককেই ধর্ষণে তাড়িতও করে। একই সঙ্গে ভারতের অনলাইন এবং প্রিন্ট মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলগুলোর একটি অংশ রগরগেভাবে ধর্ষণের ঘটনার বয়ান দিয় থাকে- প্রতিদিন, অসংখ্য রিপোর্ট আছে এরকম যা খুবই আপত্তিকর। পাঠকপ্রিয় হওয়ার জন্য ২৪ঘণ্টা, এইসময় সহ নানা নামের সংবাদ মাধ্যমগুলো শুধু ধর্ষণ আর সহিংস ঘটনাগুলো যেভাবে উপস্থাপন করছে তা সত্যি-ই আপত্তিজনক। এর ফলে একই ভাষার অর্ব অঞ্চলের অন্যান্য মিডিয়াও প্রভাবিত হচ্ছে- তারা ও পাঠক টানতে তাদের মতো নিউজ করছে। এসবের ফলে চূড়ান্ত ক্ষতিটা হচ্ছে দেশ বা অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয় বৃহৎ নারী সমাজের। অথচ সংশ্লিষ্টরা একটু সচেতন হলে, তৎপর হলেই ধর্ষণের মতো ঘিনঘিনে ঘটনা নিয়ে রগরগে নিউজ করার এমন গড্ডলিকা যাত্রাটা ঠেকানো যায়।

অস্ট্রেলিয়ায় সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে যে প্রতিবেদন করা হয়, তার প্রতি ৬টির মধ্যে একটি প্রতিবেদন এ ঘটনার কিছু দায় কীভাবে যেন আক্রান্তের ওপর চাপিয়ে দেয়। এসব প্রতিবেদনে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তার ১৫ শতাংশ ওই নারীর আচার-আচরণের কথা বলে। আর ওই নারী নিজেকে কিভাবে এই বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে নেয় তার বয়ান ১৬ শতাংশ জুড়ে থাকে।

তবে শুধু ভারতেই নয়, ধর্ষণ বিষয়ে বিশ্ব মিডিয়ার চর্চা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক অচেতন নারীকে ধর্ষণের ঘটনা অনেকটাই রগরগে ভাষায় প্রকাশ করা হয়। শুনানিতে ধর্ষিতা অভিযুক্তকে নিয়ে যে বয়ান দেন তা বিশ্ব মিডিয়ার নজর কাড়ে। পরে বদলে যায় মিডিয়ার প্রতিবেদনের ভাষা। তার ধর্ষক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ব্রক অ্যারেন টার্নারের পরিচয় তুলে ধরে এবার

ধর্ষণের আগে মেয়েটিকে অবচেতন অবস্থায় আনতে কিছু খাওয়ানো হয়েছিল বলা হয় প্রতিবেদনগুলোতে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত অবচেতন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে তথ্য দেয় মিডিয়াগুলো। তারা কোথাও `ওই নারী অতিরিক্ত মদ খেয়েছিলেন` বা `ধর্ষণ করার মতো পরিবেশ তৈরি করেছেন` এর মতো ভাষা ব্যবহার করেনি। এ ঘটনা নিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, ইউএসএ টুডে, টাইম, সিএনএন, স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড, এমএসএনবিসি এবং বিবিসি`র মতো বড় বড় মিডিয়া প্রতিবেদন করে।

এসব ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুতের নিয়মও রয়েছে। ভারতের ফেমিনিজম-এ নিয়ম-কানুন প্রকাশিত হয়। সেখানে ধর্ষণের শিকার বেঁচে যাওয়া নারীদের নিয়ে এমন কিছু লেখা যাবে না যা তাদের ঘাড়ে কিছুটা হলেও দায় চাপায়। যেমন- ওই নারীর এমন কিছু করেছেন বা লিখেছেন বা এমন কোথাও গিয়েছেন বা বলেছেন এবং এ কারণেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন- এমন কিছুই প্রকাশ হবে না।

এমন পটভূমিতে বিশাল জনসংখ্যার দেশ ভারতে ধর্ষণ বিষয়ক সাম্প্রতিক ঘটনায় নারী সহিংসতা বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে দেশটির অধিকাংশ মিডিয়াকে আরো অনেক বেশি সচেতন হওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন মানতে হবে এবং অন্যথায় প্রতিবেদক বা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিও জোর দেওয়া হয়। সূত্র: ডন, ফেমিনিজম,টাইম

নিউজওয়ান২৪.কম

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত