ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

তখন কী বলেছিলেন আর এখন করছেন কী, সু কি!

আহ্‌সান কবীর

প্রকাশিত: ১৫:০৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ১৫:৪০, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

গণহত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সু কির ক্ষমাহীন নিরবতায় রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদী পোস্টার   -ইন্টারনেট থেকে

গণহত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সু কির ক্ষমাহীন নিরবতায় রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদী পোস্টার -ইন্টারনেট থেকে

সম্প্রতি মিয়ানমারের ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এবং আমাদের অনেকের ‘প্রাণপ্রিয়’ ‘গণতন্ত্র দেবী’ অং সান সু কি আপা তার দেশে চলমান গণহত্যাকে এক ধরনের বৈধতা দিয়ে ফেলেছেন। এমন ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনে তার ক্ষমাহীন নিরবতাকে সম্মতির লক্ষণ হিসেবেই প্রমাণিত হচ্ছে।

সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে দেশটিতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে অভিযানে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তারা সেখানে নির্বিচার হত্যা করছে নিরীহ নিরস্ত্র অবলা নারী-শিশু ও পুরুষকে।

বিশ্বজুড়ে অভিযোগ উঠেছে, দেশটিতে সামরিক শাসনের অধীনে সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা জাতিগত নির্যাতন থেকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বর্তমানে ক্ষমতাসীন এনএলডি (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি) বস সু কি কোনো রা করেননি।

তার দেশের গণধর্ষিত নারীরা প্রাণটুকু অন্তত বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। বার্মিজ সেনা ও উগ্রবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের চালানো হত্যা-নির্যাতনে গত প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশে ক্রমে ক্রমে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। অসহায় এই মানুষগুলোর ন্যুনতম মানবিক চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে পড়তে হচ্ছে নানান সমস্যায়।

কিন্তু ‘বিশাল বটবৃক্ষ গণতন্ত্র’ সু কি আপাকে মনে হচ্ছে এবার মঙ্গলগ্রহে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে (এর আগে ১৫ বছর তিনি গৃহবন্দি ছিলেন)। তার এখনকার ভাবগতিকে মনে হচ্ছে তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর তার সেনাদের চালানো হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়ন সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

এদিকে, যুক্তরাজ্যের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে লন্ডনের কুইন মারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বক্তব্য তুলে ধরে বলেছে- সু কির এভাবে চুপ করে থাকাটা চলমান গণহত্যাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে এবং রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের পথ সুগম করে দিচ্ছে।

প্রিয় পাঠক, আসুন এখন দেখে নেই অতীতে আমাদের ‘গণতন্ত্রওয়ালী’ সু কি ম্যাডাম গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার সম্পর্কে কী কী বয়ান করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে না, তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে আসলে ভয়। যারা ক্ষমতার দণ্ড চালায় তাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ক্ষমতা হারানোর ভয়। আর শাসিতদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে ক্ষমতার কষাঘাতের ভীতি। দুনিয়ায় ভীতিই হচ্ছে সত্যিকারের কয়েদখানা। আর সত্যিকারের মুক্তি যদি কিছুতে থেকে থাকে তা হচ্ছে- ভয় থেকে মুক্তি।”

সু কি আপায় আরও কইছিলেন, “বিশ্বজুড়ে মানবজাতির প্রয়োজন হচ্ছে স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা যার দ্বারা নিজেদের সবটুকু সম্ভাবনা অনুভবের করতে পারে তারা।”

তার দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমস্যা-সংকট প্রসঙ্গে আশারবাণী শুনিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমরা একটি টেকসই সমাধানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা দেশের মধ্যকার সবগুলো গোষ্ঠীর জন্য নিশ্চিত করবে শান্তি, স্থিতি আর উন্নয়ন।”

তার খুবই আবেগঘন ওইসব বক্তব্যের এই চুম্বক অংশগুলো বিভিন্ন স্থানে ‘কোটেশন’ বা গুরুত্বপূর্ণ উক্তি হিসেবে ব্যবহৃতও হয়ে থাকে।

অর্থা এই কথাগুলো ফেসবুকে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ‘অকাল চুল পাকনা’ বাচ্চা বুদ্ধিজীবীর আজাইরা প্যাঁচাল মনে করবেন না। কথাগুলো বলেছেন রীতিমতো নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অং সান সু কি আপা- যাকে প্রতিবেশী বাংলাদেশসহ তার দেশ বার্মা এবং দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ গণেতন্ত্রের মানসকণ্যা বলে মনে করতো- বা এখনো অনেকে সেই বিভ্রমে আছেন।

সু কি নিজের পরিচয়ের বাইরে আধুনিক বার্মার জাতির পিতা অং সাংয়ের কনিষ্ঠ কন্যা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ৭১ বছর বয়সী এই নেত্রী তার দেশে অর্ধশতাব্দীর অধিককাল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে থাকা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতে নিজেই যেন একটি গণতান্ত্রিক ইন্সটিটিউট হয়ে গেছেন। তিনি নিজেই যেন গণতন্ত্রের প্রতিরূপ- বৃহৎ এক গণতন্ত্র।

আরও পড়ুন বারবার ধর্ষন করা হয়েছে: সুকির দেশ থেকে পালিয়ে আসা নারীদের আর্তনাদ

ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে জন্ম নেওয়া আধুনিক বার্মার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এই ‘বিশাল গণতন্ত্র’ একটা সময়ে নিজ দেশে গৃহবন্দি ছিলেন প্রায় ১৫ বছর। চলতি বছর দেশটিতে অনুষ্ঠিত অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয়ী হয় তার দল এনএলডি।

সে সূত্রে তিনি এখন দেশটির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্টেট কাউন্সেলর (স্টেট কাউন্সেলর পদটি নয়া সৃষ্ট। নির্বাচনে জিতেও আইনি জটিলতায় প্রেসিডেন্ট হতে না পারায় দেশ শাসনের সুবিধার্থে সু কি নিজের জন্য নয়া সাংবিধানিক এই পদ সৃষ্টি করেন আইন পরিষদের মাধ্যমে)।

এখানে আরও স্মরণ করা যেতে পারে গত সেপ্টেম্বরে জাতিংঘে দেওয়া বার্মিজ নেত্রী সু কি তার দেশে রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রসঙ্গে কী বলেছিলেন।
মিয়ানমারের ক্ষমতায় থাকা নেতা হিসেবে জাতিসংঘে দেওয়া ওই প্রথম ভাষণে তিনি জানান- সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের রক্ষায় তার দেশ সচেষ্ট রয়েছে। যওি তিনি রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলতে অস্বীকৃতি জানান। তার এবং তার দেশে সেনাপতিদের ভাষ্য এখানে এক- শত শত বছর সেখানকার বাসিন্দা রোহিঙ্গারা হচ্ছে বাংলাদেশি!

এদিকে, আরও হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা ইস্যু প্রসঙ্গে সু কি রাখাইন স্টেটের জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে যে অ্যাডভাইজারি কমিশনের কথা বলেছেন- তাতে কিন্তু কোনো রোহিঙ্গা প্রতিনিধির স্থান রাখা হয়নি। এতেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কতোটা গণতন্ত্রকামী, কতোটা মানবতাবাদী আর কতোটা যৌক্তিক।

আমি ভেবে পাই না বৃদ্ধত্ব পার হয়ে অশীতিপরতার দিকে ধাবমান এই ‘একদা মহান’ নেত্রী কীভাবে এমন করতে পারেন! বয়স আর অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে তো তার এখন আরও মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক হওয়ার কথা। কিন্তু…

প্রসঙ্গত, দুনিয়ার অন্য অনেক পুরস্কারের মতো নোবেল পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে বিস্তর। যোগ্য অনেক লোককে এই পুরস্কার না দিয়ে অযোগ্যদের দেওয়া হয়েছে- এমন অকাট্য অভিযোগ অনেক রয়েছে। কিন্তু সু কি আপা, কন তো দেহি, আপনের পুরস্কারটাও কী হেই রকম ‘খয়রাতি পুরস্কার’! নাকি টাকা পয়সা দিয়ে ‘কেনা পুরস্কার’! আপনি তো বার্মা মুল্লুক ছাড়িয়ে প্রতিবেশি বাংলাদেশ হয়ে দুনিয়ার আনাচে কানাচে মানুষের মনে মনে স্থান পাওয়া নেত্রী ছিলেন! পুরস্কার পাওয়া নেত্রী হিসেবে তো আপনাকে মনে স্থান দেয়নি দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ।

স্বীকার করি- নোবেল দেনেওয়ালারা গরীব মানুষের রক্তচোষা সুদ-ঋণের ব্যবসাদার ব্যক্তিকেও পুরস্কার দিয়েছে। দুনিয়ায় চলমান অসংখ্য যুদ্ধ নামক আজাবের মূল ক্রীড়নক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তো আপনার মতো শান্তিতে নোবেল পাইছেন (এক্ষেত্রে তিনি অবশ্য অসাধারণ সততার প্রমাণ দিয়েছেন এই কথা বলে যে, তাকে নোবেল কেন দেওয়া হইছে তিনি আসলে তা জানেন না)।

আপনি শুধু শান্তিতে নোবেলই পাননি- আপনি সম্মানিত হয়েছেন মর্যাদাকর শাখারভ পুরস্কারেও। তবে আমরা কিন্তু আপনাকে পুরস্কারের মাপকাঠিতে মাপিনি। গণতন্ত্রের জন্য আপনার চালানো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আপনার চোখের পানি আমাদেরকেও অশ্রুসিক্ত করতো। কই, এখন আপনার চোখ কেন ভিজছে না আপনার সেনাবাহিনী কর্তৃক ধারাবাহিক গণধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের আর্তনাদে! হাজারের ওপর বাড়িঘর জ্বালানো হলো- আপনার মুখে রা নেই। কয়েক শ নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করা হলো- আনি নিশ্চুপ!

এটা বাস্তব যে আপনার ক্ষমতার একটা অংশ এখনও রয়েছে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে (বার্মিজ পার্লামেন্টের ২৫% আসনে সেনাবাহিনীর কোটা রয়েছে)। অর্থাৎ বার্মিজ পার্লামেন্টের একটা অংশ (কিছুসংখ্যক সাংসদ) সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের তপ্লীবাহক। কিন্তু এই জেনারেলরা, এই সেনাবাহিনী তো আগে আরও হাজারগুণ শক্তিধর ছিল যথন আপনি আন্দোলনের মাঠে ছিলেন।

এখন তো পরিস্থিতি সেই তুলনায় অনেক উন্নত! রাতদিন পার্থক্য বলা যায়। আপনি কীভাবে চুপ থাকতে পারেন নিপরাধ সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ-শিশুদের হত্যায়। সংখ্যালঘু শিশুদের আগুনে ফেলে হত্যা করছে আপনার সেনাবাহিনী! নিজেকে একবার চিন্তা করুন সেই দুই রোহিঙ্গা সহোদর বোনের স্থানে- যাদেরকে বিছানায় বেঁধে রেখে দলে দলে বার্মিজ সৈনিকরা চালিয়েছে গণধর্ষণ।

আপনার অন্তরাত্মা কি কেঁপে উঠছে না!

এই অভিযানের পেছনে মূল ক্রীড়নক ভাবা হচ্ছে মিয়ানমার আর্মড ফোর্সেসের (তাতমাদাও) কমান্ডার সিনিয়র জেনারেল মিং অন হ্লাইংকে। তবে অনেকেই এটা মনে করছেন যে এসময় নিশ্চুপ থেকে রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে আসলে আপনি নিজেই রোহিঙ্গাদের ওপর এই হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ চালাচ্ছেন সেনাবাহিনীকে শিখণ্ডি বানিয়ে- খুশি করছেন কট্টরপন্থি মৌলবাদী বৌদ্ধদের একটি অংশকে। আর ভবিষ্যতে অভিযোগ থেকে বাঁচতে সেনাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজে ক্লিন থাকবেন- হয়তো ভেবে রেখেছেন এমনই।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নৃশংসতা প্রসঙ্গে আপনার অধীন প্রেসিডেন্টের অফিস বলছে, এসব আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অতিরঞ্জিত খবর আর স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপের কর্ম। আর এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য নিতে আপনাকে গরুখোঁজা করছে সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো। আপনি মুখে পুরোপুরি কুলুপ দিয়ে বসে আছেন। বাহ্‌ গণতন্ত্রবাদী নেত্রী, বাহ মানবতাবাদী নেত্রী! একেই তো বোধহয় বলে ‘ক্ষমতার রাজনীতি’। সবদেশে, সবকালে এর কদর্য রূপ হয়তো একই।

আপনি বলেছিলেন, “যারা ক্ষমতার দণ্ড চালায় তাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ক্ষমতা হারানোর ভয়।” এখন কি সেই ক্ষমতা হারানোর ভয় আপনাকে পেয়ে বসেছে? আপনি আরও বলেছিলেন, “দুনিয়ায় ভীতিই হচ্ছে সত্যিকারের কয়েদখানা।” এখন কি তাহলে ক্ষমতা হারানোর ভীতির কয়েদখানায় বন্দি আপনি? আপনি আরও বলেছিলেন, সত্যিকারের মুক্তি যদি কিছুতে থেকে থাকে তা হচ্ছে- ভয় থেকে মুক্তি।” সেই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা কি আপনি এখন করবেন?

অন্ধ স্বার্থে ‘দুই নম্বরী’ নেতাদের পল্টিবাজী-ডিগবাজী মারা স্বভাবকে টিপ্পনি করে এদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে- যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। যুগের পরিবর্তনে এখন মনে হচ্ছে কথাটা বদলে বলতে হবে- যে যায় ক্ষমতায় সেই হয় সু কি! আপনার মতো রাম থেকে রাবণ বনে যাওয়াদের নিয়ে এছাড়া করার আর আছে কী- আমাদের মতো অসহায় সাধারণের।

(ভিনভাষী এই লেখা আপনার পড়া হবে না হয়তো, জানি। তবে আপনাকে এতদিন ‘গণতন্দ্রের দেবী’ মনে করা আপামর জনতার মনের বিভ্রম কিছুটা কাটবে- এই আশায় এইসব লেখালেখি, আর কী, প্রিয় সু কি)! [email protected] 

নিউজওয়ান২৪.কম/এসএ

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত