ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

জরিমানা ২০০%: ভারতে হাজার ও ৫০০ রুপির নোট বাতিলের আসল কারণ

অর্থ-কড়ি ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:১১, ১০ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ২০:১১, ১১ নভেম্বর ২০১৬

এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, এরপর করেছেন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে, সবশেষে গেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে। এরপর তিনি ঘোষণা দেন- দেশে প্রচলিত পাঁচ শ ও এক হাজার টাকার সব নোট অতি শিঘ্র বাতিল করা হবে।

এ সূত্রে জনগণের কাছে থাকা হাজার ও পাঁচ শ টাকার নোট বদলাতে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়। এরপর ওইসব নোট স্রেফ কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছু হিসেবে গণ্য হবে না।

বিষয়টি অনেকের কাছেই তুঘলকি কাণ্ড বলে মনে হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় বলা হয়- কালো টাকা সঞ্চয়কারীদের দমনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে ভোগান্তি। রাজধানীসহ সমগ্র ভারতে এটিএম তথা ক্যাশ ডিপোজিট মেশিনের (সিডিএম) বুথে, ব্যাংকে ভীড় লেগে গেছে।

গত মঙ্গলবার নোট বাতিলের ঘোষণায় মোদি বলেছেন, দেশ থেকে কালো টাকা ও জাল নোট উধাও করার জন্য এটুকু ভোগান্তি দেশবাসী সহ্য করবেন বলেই তার বিশ্বাস।

সর্বশেষ সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, বৈধ আয়ের চেয়ে বেশি অর্থের জন্য জরিমানা করা হবে ২০০% হারে। এই বিষয়টাই অবৈধ অর্থ কিংবা কালো আর জাল টাকার মালিকদের পঙ্গু করে দেবে। আক্ষরিক অর্থেই ওই অর্থ তাদের কাছে স্রেফ ছাপানো রঙিন কাগজ ছাড়া আর কিছুর অর্থ বহন করবে না। এবং এই কাগজগুলো তারা কোথাও দেখাতেও পারবে না। কঠিন প্যাঁচই বটে।  

বিষয়টি অনেকেই প্রথম দিকে ঠাহর করতে পারে নাই। এ নিয়ে দেখা দেয় অস্পষ্টতা। বিরোধী দল কংগ্রেস থেকেও এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

তবে হঠাৎ করে দেওয়া এই ঘোষণা একেবারে ফালতু কোনো আইডিয়া না। অন্তত কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়ছে যেসব উন্নয়নশীল বা উন্নয়নের পথে কিছুদূর অগ্রসর হওয়া দেশের সরকার- তাদের জন্য এই কায়দাটা অনুসরণীয় হতে পারে।

এখানে একটি আপাত সহজ তবে জটিল কৌশল অনুসরণ করছে ভারত সরকার। কোনো ব্যক্তি ব্যাঙ্কে পাঁচশো বা হাজারের নোট নিয়ে গেলেই ব্যাঙ্ক ওটা সঙ্গে সঙ্গে বদলে দেবে না। ওটা তার অ্যাকাউন্ডে জমা করতে হবে আগে। তারপর গ্রাহক এর সমপরিমাণ টাকা তুলতে পারবেন এটিএম বুথ থেকে বা তার ব্যাংকের কাউন্টার থেকে।

অর্থাৎ এ কায়দায় নিজেরই অ্যকাউন্টে আপনার জমা করা টাকার হিসাব সরকারের খাতায় পৌঁছে গেল। মোটা টাকা ব্যাঙ্কে জমা করতে গেলে প্যান নম্বর (পারসোনাল অ্যাকাউন্ট নাম্বার, আয়কর বিভাগ থেকে দেওয়া হয় ১০ ডিজিটের এই নম্বর) দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর অর্থ, টাকা বদলাতে গিয়ে লোকজন তার টাকার পরিমাণ নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকারকে জানিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

একই সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক পরিমাণে অর্থ জমা করলে ইনকাম ট্যাক্সের লোকজন এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরবে। ফলে যারা ঘরের ফলস সিলিংয়ের নিচে, বিছানার তলায়, মাটির নিচে বা কমোডের সিস্টার্নে টাকার তোড়া জমিয়ে রাখছিলেন এতদিন, রাতারাতি সেসব টাকা কাগজ হয়ে যাবে। কারণ, এগুলো বদলাতে না পারলে আসন্ন শীতে সেসব নোটে আগুন ধরিয়ে ওম নেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজে লাগবেনা বলেই মনে হয়। তাই হবে নির্দিষ্ট সময় পর।

আর সেসব নোট বদলাতে গেলে সরকার জেনে যাবে আপনার কাছে ‘অ্যাত্তো টাকা’ জমে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে জরিমানা- পড়তে হবে আরও হরেক পদের ক্যাঁচালে।

ধারণা করা হয়, বর্তমানে এই কালো টাকার পরিমাণটা ভারতে কয়েক লাখ কোটি বললেও কম বলা হয়। অনেকেই মনে করেন, দেশের দু’একজন মন্ত্রী বা আমলার একার কাছেই এমন কয়েক লাখ কোটি টাকা মিলবে।

এ নিয়ে কেউ কেউ বলছেন- সরকারের এই কায়দার ফলে সাধারণ মানুষ বিপদে পড়বে। দিন আনি দিন খাই বা দিনমজুর কিংবা চা-বাগানের শ্রমিক টাইপ লোকদের দৈনিক মজুরি দিতে বেকায়দায় পড়বে মালিক বা গৃহস্থ। ফলে তাদের ঘরে চুলো জ্বলবে না। এর জবাবে এ পদ্ধতির সমর্থকরা বলছেন- আপনি আগামি দুদিন কীভাবে বাজার করবেন তা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে ভাবতে বসলে চলে না। আর দিন-আনি-দিন-খাই লোকেরা আপনার মতো সবসময় পকেটে পাঁচশো-হাজারের নোট নিয়েও ঘোরে না। রাস্তা মেরামত করতে হলেও তো দুদিনের জন্য সেই রাস্তা বন্ধ করতে হয়। মধ্যবিত্ত তো তা নিয়েও গজগজ করতে ছাড়ে না।

আরেকটি বিষয় সম্পর্কে বলেন শংকর লাল নামে একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। তার মতে, ভারতে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি– এটা যেমন সত্য, তার থেকেও ভয়ংকর সত্য হল, ভারতে ছড়িয়ে থাকা পাবলিক মানির বেশিরভাগটাই বর্তমানে জমে গেছে মাত্র দশ শতাংশ ধনী লোকের হাতে। সেই কালো টাকা খাটে ভোটে, গয়নার বাজারে, ধর্মপ্রতিষ্ঠানে, সিনেমায়...। এরই নাম ছায়া অর্থনীতি।

তার মতো অনেকেই মনে করছেন- কালো টাকা মানে পরিবের অধিকার হরণ করে পুঞ্জীভূত করা অভৈধ এই বিত্তের বিষবৃক্ষের গোড়ায় কুড়ুলের একটা জব্বর কোপ পড়ল এই কায়দার মাধ্যমে।

উল্লেখ্য, পরিস্থিতি সামলাতে বাজারে নয়া ৫০০ ও দুই হাজার টাকার নোট ছাড়ার ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। এছাড়া প্রচলিত পাঁচ শ ও এক হাজার রুপির নোট জমা নিতে সরকারের অন্যান্য নির্দেশনাগুলো নিম্নরূপ

• ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ব্যাংক বা ডাকঘরে নিজের অ্যাকাউন্টে যে কেউ যত টাকার খুশি পুরনো নোট জমা দিতে পারেন
• এরপরও ওই দুই মানের নোট জমা নেওয়া হবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু নির্দিষ্ট শাখায় তা করা যাবে, ৩১ মার্চ পর্যন্ত। তবে তা অবশ্যই জমা নেয়ো হবে পরিচয়পত্র দেখে
• এছাড়া পরিচয়পত্র দেখালে ২৪ নভেম্বর অবধি ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত অঙ্কের পুরনো নোট বদলাবে যেকোনো ব্যাংক, ডাকঘর
অনেকেই অবশ্য বলছেন, মোদির এই কায়দায় জাল টাকা হয়তো ঠেকানো যাবে- তবে কালো টাকা ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। কারণ, বড় বড় কালো টাকার মালিকরা কখনো বাড়ির সিন্দুকে, তোষকের তলায়, গোয়াল ঘরে, রিজার্ভ ট্যাঙ্কে নগদে টাকা সঞ্চয় করেন না। তাই, এতে মধ্যমা পর্যায়ের কিছু কালো টাকাওয়ালা ধরা পড়বে- কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
দেখঅ যাক- সামনে আসলেই কী ঘটে!

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

অর্থ-কড়ি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত