ঢাকা, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪
সর্বশেষ:

অন্ধকারের চোখ

হুমায়ূন রেজা

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ১২:০৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

অন্ধকারের কি চোখ থাকে? হৃদয়? অন্ধকার তো মানুষ নয় যে তার দুটো চোখ থাকবে। পা থাকবে, হাত; কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো হেঁয়ালি করে বললেও এ বড় কঠিন সত্য। সংবাদশ্রমিক মাত্রেই অর্ধমানব গোছের। আধামানুষ।

সকালবেলায় চোখ আটকে যাওয়া শিরোনাম আর অসাধারণ মুহূর্তের, বর্ণিল হরেক ছবিতে সেজে যে সংবাদপত্রটি আপনার হাতে ওঠে, যে টিভি সংবাদে আপনি চোখ মেলে থাকেন, যে অনলাইনের ব্রেকিং নিউজ দেখে ফেসবুকে দেন সচেতনতার স্ট্যাটাস... তার পেছনের খেটে খাওয়া সংবাদমাধ্যম কর্মী, আপনারা যাকে সাংবাদিক হিসেবে চেনেন; সে শ্রমিকটির বঞ্চিত চেহারা নজরে পড়বে- এমন চোখ সৃষ্টিকর্তা আপনাকে দেননি। আর যারা মানেন না তাদেরও তা নেই।

রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরে এইসব অন্ধকার তাদের ক্লান্ত চোখ মেলে চেয়ে দেখে তার ঘুমন্ত সন্তানের নিষ্পাপ মুখের দিকে; অসহায় এক বাবার চোখে। অথচ এ চোখ না থাকে মালিকপক্ষের না সরকারের। এদেশে সবচেয়ে বঞ্চিত পেশাজীবী শ্রেণিটির সার্বিক পরিচয় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়। নিছক অন্ধকার, ব্যাস এটুকুই। রাতের গায়ে যে লেপ্টে থাকে অশরীরী হয়ে।

সংবাদমাধ্যমে আমার দীর্ঘ দুই যুগের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি গণমাধ্যমে দু জাতের মানুষ আছেন। একটা অংশ ন্যাজ মুছে বনেদী ও সুযোগসন্ধানী- তারা সংখ্যায় স্বল্প। আর বাকি অংশ? তাদের ঘাড়েই মূলত সংবাদ সংগ্রহ থেকে পরিবেশনা- তাবৎ কাজের জোয়ালটা চেপে বসে থাকে অদৃশ্য ফাঁসের মতো। এক কথায় তারা সর্বহারা। কিন্তু রোখটা তাদের রাজার। সেটা নেশাও বটে। এ এক সর্বনাশা নেশা। সত্যকে তুলে ধরার, অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার।

দুমাস বেতন নেই, ঘরে চাল বাড়ন্ত, বাচ্চার বেতন দিতে পারেননি এমন অনেক সর্বহারা গণমাধ্যমকর্মীই টানা ১২ ঘণ্টা জঙ্গিবাদ আর জামাতের, স্থানীয় থেকে জাতীয় দুর্নীতিবাজদের সংবাদ সংগ্রহ আর তা ছাপার জোয়াল ঘাড়ে নিয়ে ভুলে থেকেছেন নিজের ঘরের যন্ত্রণার কথা। কিন্তু পরিণামে? অভাব আর গ্লানির পাহাড় জমেছে ঘাড়ে।

পরিণামে হত্যার হুমকি, পরিণামে নির্মম মৃত্যু। এ সংক্রান্ত খবরের আয়ূও নাজিম হিকমতের কবিতার শোকের আয়ূর মতোই! বড়জোর এক বছর। সাগর-রুনির কথা নাকেমুখে সংবাদ সামলে আমাদেরই যে মনে পড়ে না।। তবে? তা হলে? প্রাপ্তি বলে তো কিছু থাকবে! নাকি? সে আছে, সে এক কল্পতরু। স্বপ্নের সাজানো বাগানে। তার ডালে ডালে থরে থরে এক স্বপ্নের, সাম্যের অধরা পৃথিবীর স্বপ্ন জেগে থাকে। তার কথা ভাবতে ভাবতেই চলে গেছেন মোনাজাত উদ্দীন।

অকালে ঝরে গেছেন এমন অসংখ্য স্বপ্নবাজ মানুষ। অবশ্য আপনি যদি তাদের মানুষ বলে মনে করেন তবেই।

সংবাদপত্রের মধ্যে যে রাজনৈতিকতা, যে পক্ষপাত ও মুখ বুঁজে থাকা, যে গড্ডল প্রবাহে ভেসে চলা, দেখেও না দেখার ভান করা, প্রথম পাতা থেকে সটকে ভেতরের পাতার এক কলামে সাদাকালোয় বিশেষ খবর। ছাপলে মস্তক, না ছাপলে ইজ্জ্বত যায়! তাই কায়দা করে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ কায়দায় ছাপার আপোষকামিতা- সাম্প্রতিক সময়ে এ যেন আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে।

শুধু ছাপাখানা হয়ে বাড়ি আসা কাগজেরই নয়, চরিত্রস্খলন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি টেলিভিশনের। টক শো থেকে শুরু করে বলিহারি বিনোদন- এ যেন এক মুখোশ নাচের প্রতিযোগিতা। সাম্প্রতিক ‘সুলতান সুলেমান’ নিয়ে যে কেচ্ছা-কাহিনি এখন চলছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে বানরের পিঠা-ভাগের সেই প্রাচীন গল্প। এখানে সংস্কৃতি রক্ষার চাইতে ঢের বেশি কাজ করেছে মোহরের লোভ। কিন্তু “দেখবো না, দেখছি না” বলে মুখ ঢেকে রাখা দুহাতের দশ আঙুলের ফাঁক গলে যা চোখে পড়ে তা যেন এক অন্ধকারের চোখে দেখা অসহায় দেশ।

মফস্বল থেকে উঠে আসা শীত যেমন গুটি গুটি পায়ে এই রাজধানী শহরের দিকে এগিয়ে আসছে তেমনি পুরো গণমাধ্যমকেই যেন ছেয়ে ফেলছে বোধহীনতার শৈত্য। এক মৃত্যুর অধিক স্থবিরতা। অন্ধকারের চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আমরা কেইবা কী পারছি!

হুমায়ূন রেজা: সাংবাদিক, কবি

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

 

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত